সালাহউদ্দিন সেই ছবিটা খুঁজছেন

Slider জাতীয়

76212_f1

 

 

 

 

শিলং। মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পেরিয়ে ৮০ কিলোমিটারের পথ। হঠাৎ করেই ভারতের ছোট্ট এই শহরটি বাংলাদেশে আলোচনার শীর্ষে। খুব উন্নত নয়। সাধা-সিধে জীবন শহরের বাসিন্দাদের। সাকুল্যে জনসংখ্যা তিন লাখ। বেশির ভাগের পূর্ব-পুরুষের বাস সিলেটে। বাংলা বলতে পারেন অনেকেই। তবে সিলেটি বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ কিভাবে শিলং গেলেন অথবা কিভাবে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো এবং কিভাবে তাকে পাওয়া গেল- এ প্রশ্ন এখনও জ্বলন্ত। ১১ই মে ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। জায়গাটির নাম শিলং গলফ লিংক। বাসিন্দাদের কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠেছেন। কেউ বেরিয়েছেন কাজের সন্ধানে। হঠাৎ তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ পঞ্চাশোর্ধ অচেনা এক ব্যক্তির প্রতি। তার মুখে লম্বা দাড়ি। চেহার বিধস্ত। উদভ্রান্ত। স্থানীয় মানুষদের কাছেই তিনি জানতে চান, জায়গাটির নাম। তাদেরই বলেন, তাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যেতে। লোকটির নাম সালাহউদ্দিন আহমেদ।  শিলং গলফ লিংকের কাছে বসবাস করেন দিনমজুর মোহাম্মদ শাহ আলী। গত রোববার মানবজমিন-এর কাছে তিনি বর্ণনা করছিলেন কিভাবে সালাহউদ্দিন আহমেদকে দেখতে পান তিনি। বলেন, ভোরের দিকে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে গলফ লিংকের মোবাইল টাওয়ারের কাছে জটলা দেখতে পাই। এগিয়ে যেতেই দেখি দাড়িওয়ালা একটি লোক বসে আছেন। আমার কাজ থাকায় চলে যাই। এরপর কি হয়েছে জানি না। সরজমিনে এলাকাটিতে গিয়ে দেখা যায়, গলফ লিংকের চারপাশ গাছপালায় ভরপুর। গলফ খেলার জন্য বিস্তৃত মাঠ। এর শেষ মাথায় একটি হোটেল ঘর। এর পাশেই খুপড়ি বস্তিঘর। ওই বস্তিঘরের অনেক বাসিন্দা তখন সালাহউদ্দিনকে দেখতে আসেন।

একপর্যায়ে সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে যাওয়া হয় শিলংয়ের প্যাসটিওর বিট হাউস পুলিশ ফাঁড়িতে। পুলিশের কাছে নিজেকে তিনি পরিচয় দেন বাংলাদেশের একজন সাবেক মন্ত্রী ও বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতা হিসেবে। শুরুতে অবশ্য সিলং পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করেনি। পুলিশ ফাঁড়িতে লম্বা দাড়ি আর বিধ্বস্ত চেহারার সালাহউদ্দিন আহমেদের ছবি তোলেন সাব-ইন্সপেক্টর পি-লামারাই। নিজের মোবাইল ফোনে এ ছবি তোলেন তিনি। শিলং সদর পুলিশ স্টেশনে সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে দায়ের করা অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলার (ফরেনার্স অ্যাক্ট) তদন্তকারী কর্মকর্তাও তিনি। কয়েক দফায় এ প্রতিনিধির কথা হয় তার সঙ্গে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, লম্বা দাড়িসহ ছবিটি পেতে চাইছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। নিজের আত্মীয়- স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে ছবিটির বিষয়ে বলেছেন। সালাহউদ্দিন তাদেরকে বলেন, আত্মসমর্পণকালীন সময়ে আমার লম্বা দাড়ি ছিল। মাথাসহ অন্য চুলের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। এছাড়া নখগুলো ছিল লম্বা লম্বা। এসব কারণে নানা চর্মরোগ দেখা দিয়েছে।
এদিকে গতকাল কিডনি ও হার্টসহ নানা সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় শিলংয়ের সিভিল হাসপাতালের ইউটিপি সেল থেকে নর্থ ইস্টার্ন ইন্দিরা গান্ধী রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড মেডিক্যাল সায়েন্সেস (নিগরিমস) বিশেয়ায়িত হাসপাতালের ইউটিপি সেলে স্থানান্তর করা হয়েছে সালাহউদ্দিনকে। স্থানীয় সময় সাড়ে পাঁচটার দিকে তাকে স্থানান্তর করা হয় বলে শিলংয়ে অবস্থানরত দুই বিএনপি নেতা জানিয়েছেন। এছাড়া মামলা মোকাবিলার জন্য মেঘালয়ের সিনিয়র আইনজীবী এসপি মোহান্তকে নিয়োগ করেছেন সালাহউদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। গত দুইদিন কয়েক দফা ওই আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন বিএনপি’র সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি।
মিমহ্যানস মেন্টাল হাসপাতালে দাড়ি কাটা হয়: গলফ লিংক থেকে সালাহউদ্দিনের মুখে তার পরিচয় শুনে অবিশ্বাস ও সন্দেহ হয় সাব-ইন্সপেক্টর পি-লামারাইয়ের নেতৃত্বাধীন পুলিশ সদস্যদের। কারণ সালাহউদ্দিনের মুখভর্তি দাড়ি, হাতে ও পায়ে বড় বড় নখ, লম্বা চুল। বিধ্বস্ত চেহারা। এরপর সালাহউদ্দিনের অপ্রকৃতিস্থ চেহারার বিষয়টি জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা। পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ অনুযায়ী মিমহ্যানস (মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল অ্যান্ড নিউরোজিক্যাল সায়েন্স) মেন্টাল হাসপাতালে তাকে নেয়া হয়। ওই হসপিটালেই তার চুল, দাড়ি ও নখ কাটা হয়। এর আগে প্যাসটোর বিটহাউজে গিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, আমি কিন্তু বাংলাদেশের একজন ভিআইপি। আমি ওই দেশে স্টেট মিনিস্টার ছিলাম। এরপর তার সঙ্গে কোন টাকা-পয়সা বা কাগজপত্র না পেয়ে পুলিশ মেলাতে পারেনি। শিলং পুলিশ প্রথমে পাগলের প্রলাপ বলে মনে করে। এরপর তাকে কিভাবে শিলং এলেন একথা জিজ্ঞেস করা হলে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তার এ অবস্থা দেখে মিমহ্যানসে তাকে নেয়া হয়। এরপরই সবকিছু ছেঁটে তার ছবি তুলে গণমাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
সালাহ উদ্দিনকে সিভিল থেকে নেগ্রিমস হাসপাতালে স্থানান্তর: বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের মেঘালয়ের নর্থ ইস্টার্ন ইন্দিরা গান্ধী রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ অ্যান্ড মেডিক্যাল সায়েন্সেস, শিলং (নেগ্রিমস) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। গতকাল স্থানীয় সময় বিকাল ছয়টার দিকে তাঁকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সিভিল হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় সালাহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, আমার শারীরিক অবস্থা মোটেও ভাল নয়। সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য তিনি মেঘালয় রাজ্য সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সালাহ উদ্দিনের বাম পাশের কিডনির সাইজ বড় হয়ে গেছে। গলব্লাডারে স্টোন দেখা দিয়েছে। এসব বিশেষায়িত চিকিৎসা ব্যবস্থা সিভিল হাসপাতালে নেই। এ কারণেই তাকে নেগ্রিমসে স্থানান্তর করা হয়েছে। সিভিল হাসপাতালে সালাহ উদ্দিনের কার্ডিওলজিস্ট জি কে গোস্বামী সাংবাদিকদের বলেন, সালাহ উদ্দিনের কিডনিতে পাথর (গলব্লাডার স্টোন) ধরা পড়েছে। তাঁর আরও কিছু শারীরিক সমস্যা রয়েছে। সালাহ উদ্দিনের চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তাররা মনে করেন, তাঁর কিডনি চিকিৎসার জন্য আরও বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার। এ সুবিধাগুলো সিভিল হাসপাতালে নেই। এজন্য ডাক্তারদের তরফ থেকে নেগ্রিমসে পাঠানোর জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এর পরই তাকে নেগ্রিমসে স্থানান্তর করা হয়। এদিকে গতকাল সকালে শিলংয়ের সিভিল হাসপাতালে আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনার (ইউটিপি) সেলে চিকিৎসাধীন ওয়ার্ডে হাসিনা আহমদ তৃতীয় দিনের মতো স্বামীর সঙ্গে  দেখা করেন। বাইরে বেরিয়ে তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, সালাহ উদ্দিন আহমেদকে আইনি প্রক্রিয়ায় মুখোমুখি করার আগে তাঁর উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সালাহ উদ্দিন অনেক বছর আগে থেকেই কিডনি ও হার্টের রোগী। তাঁর পা ফুলে গেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কাঁপতে থাকেন। তাঁর উন্নত চিকিৎসা দরকার। হাসিনা আহমেদ বলেন, কিডনিসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে তিনি তার স্বামীকে সিঙ্গাপুর নিতে চান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে স্বামীকে দেখে আসার পর ডাক্তারদের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন হাসিনা আহমেদ। কিন্তু তৃতীয় দিনেও ডাক্তারদের সাক্ষাৎ পাননি।
আইনজীবীর সঙ্গে কথাবার্তা চূড়ান্ত: শিলংয়ে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণকারী বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদের পক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় লড়বেন মেঘালয় রাজ্য হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এসপি  মোহান্ত। আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে হাসিনা আহমেদ বলেন, ভারতের আইন অনুযায়ী কোন পথে যাওয়া ভাল হবে, তা বুঝে তিনি পদক্ষেপ নেবেন বলে মোহান্ত আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এর আগে মঙ্গলবারও আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন হাসিনা আহমেদ। গতকাল সকালে আবারও আইনজীবীর বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে আসেন হাসিনা। তার সঙ্গে থাকা এক আত্মীয় জানান, উন্নত চিকিৎসার জন্য সালাহ উদ্দিনকে সিঙ্গাপুরে নিতে তারা প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা করছেন। হাসিনা আহমেদ এর আগে কয়েকবার হাসপাতালে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করলেও এখন তিনি আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলছেন, এর আগে সিঙ্গাপুরেই সালাহ উদ্দিনের হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। বরাবরই তিনি সেখানে চিকিৎসা নিয়ে আসছেন। সেই চিকিৎসার কাগজপত্র নিয়েই হাসিনা শিলংয়ে এসেছেন। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, পুলিশ হাসপাতাল থেকে সালাহ উদ্দিনকে আদালতে হাজির করলে বাংলাদেশের এই  নেতাকে প্রথমে ভারতের কারাগারে যেতে হবে। আর আদালতে হাজির করার পর যদি সরকার তাকে ফেরত পাঠানোর আবেদন করে ওই বিষয়টি নিয়েই এরপর যুক্তিতর্ক হবে। উল্লেখ্য, হাসিনার সঙ্গে তার ভগ্নিপতি মাহবুব কবির ও এক আত্মীয় এবং বিএনপি নেতা আবদুল লতিফ জনি শিলংয়ে অবস্থান করছেন।

এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *