গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ বন্ধের (বাতিল) ঘোষণা দিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, কীভাবে নির্বাচন বন্ধ হলো, কোথায় বিশৃঙ্খলা ঘটল তা বোধগম্য নয়। বিএনপির নেতারা ইসির ত্রুটি তুলে ধরে বলেছেন, সংস্থাটির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছেন, নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কমিশন। তারা সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। এমন বাস্তবতায় উপনির্বাচনটির ভোটগ্রহণ কী প্রক্রিয়ায় হতে পারে, যেসব কেন্দ্রে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে সেগুলো আমলে নেওয়া হবে কিনা, নতুন করে তফসিল ঘোষণার প্রয়োজন আছে কিনা, ইসি ও প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা ছিল কিনা, ইত্যাদি প্রশ্ন জনমনে সৃষ্টি হয়েছে।
গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কী প্রক্রিয়ায় হতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক গতকাল বৃহস্পতিবার আমাদের সময়কে বলেন, ‘সংবিধানের ১২৪ অনুচ্ছেদের ৪ উপধারায় বলা আছে- আসন খালি হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন হতে হবে। তবে শর্ত আছে যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি মনে করেন দৈব-দুর্বিপাকের কারণে এই ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করা যাবে না তাহলে দ্বিতীয় ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে।’
এই উপনির্বাচন সম্পাদন করার জন্য পুনরায় তফসিল ঘোষণা করতে হবে কিনা জানতে চাইলে শাহদীন মালিক বলেন, ‘এই নির্বাচন তো বাতিল হয়ে গেছে। তফসিল ঘোষণা ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। প্রত্যেকটা পদক্ষেপ আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।’
এর আগে গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের জানান, বন্ধ ঘোষিত গাইবান্ধা-৫ আসনের ভোটে অনিয়ম তদন্তে অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। এর পরই গাইবান্ধা ভোটের পরবর্তী নির্দেশনা দেবে সাংবিধানিক সংস্থাটি। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন ইসির যুগ্ম সচিব কামাল উদ্দিন বিশ্বাস ও শাহেদুন্নবী চৌধুরী। সিইসি জানান, অনিয়মগুলো তদন্ত করে আগামী ৭ দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এই নির্বাচন বন্ধ বা বাতিল ঘোষণার পর থেকে গাইবান্ধায় বিক্ষোভ করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দলের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতারাও ইসির সিদ্ধান্তটিকে ভালোভাবে দেখছেন না। গতকাল এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গাইবান্ধা উপনির্বাচনে কী কারণে ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। প্রিসাইডিং অফিসারদের ভাষ্যমতে, নির্বাচনী কর্মকর্তাসহ সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশে ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। তবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ওবায়দুল কাদের।
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাদের দলীয় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে সেটিই প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদের একটি উপনির্বাচনে সব শক্তি নিয়োগ করেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেনি। না পারার কারণেই নিজেরাই নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা এত দিন যে কথাটি বলে আসছি, সেটার সত্যতা প্রমাণিত হলো।’
সিইসির এমন সিদ্ধান্তকে হঠকারী সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক নেতারা। এ বিষয়ে গতকাল আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন অফিসে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করা কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত ছিল না। নির্বাচন কমিশন চিন্তাভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেই নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে লিখিত বক্তব্যে সিইসি বলেন, নির্বাচনটি যেন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা গত ২৮ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা সার্কিট হাউসে উপস্থিত থেকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় বক্তব্য দেন। সভায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় প্রধান, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। পরে আমি নিজে ও কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছি যেন একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হয়।’
সিইসি বলেন, ‘সকাল ৮টায় যথারীতি ভোটগ্রহণ শুরু হয়। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, আগারগাঁওয়ে স্থাপিত কন্ট্রোলরুমে আমিসহ অন্য কমিশনাররা, দায়িত্ব পালনকারী সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কারিগরি সহায়তাকারী এবং মিডিয়ার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ভোট শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা তিনটি কেন্দ্রে দেখতে পাই ভোটকক্ষে এক প্রার্থীর পুরুষ এজেন্টরা বুকে ও পিঠে প্রার্থীর মার্কা প্রিন্ট করা একই রকম গেঞ্জি পরে আছেন। নারী এজেন্টরা একই রকম শাড়ি পরা, যা আচরণ বিধিমালার ১০ (ঙ) ভঙ্গের মধ্যে পড়ে। এসব এজেন্ট ছাড়াও আরও অনেক অবৈধ লোকজন ভোটকক্ষে অবস্থান করে ভোটারদের ভোট দিতে প্রভাবিত করছেন।’
সিইসি বলেন, ‘ভোটারদের কন্ট্রোল ইউনিটে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পরপরই এজেন্টরা গোপন ভোটকক্ষে প্রবেশ করে ভোটারকে ভোট দিতে সুযোগ না দিয়ে নিজেই ভোট দিচ্ছেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ একই কাজ করছেন। তখন কমিশন থেকে ফোন দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারদের ভোটকক্ষের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ভোটকক্ষের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তখন ওই তিনটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করার নির্দেশনা কমিশন থেকে দেওয়া হয়।’
হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘এর পর একে একে দুপুর ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ৫০টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে দেখা হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের অবস্থা একই রকম দেখা যায়। এরই মধ্যে রিটার্নিং অফিসার একটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেন। আমি এবং বেগম রাশেদা সুলতানা রিটার্নিং অফিসার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।’ তিনি বলেন, অন্য কেন্দ্রগুলোতেও সিসিটিভি দেখার সময় পেলে দেখা যেত যে ওই কেন্দ্রগুলোতেও একই অবস্থা। কমিশন মনে করে যে, এ ধরনের একটি আইনবহির্ভূত ভোটগ্রহণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।