সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য মজুতকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থার নেওয়ার জন্য গত মার্চ মাসে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। নির্দেশনায় বাণিজ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। সেই নির্দেশনার ভিত্তিতে সম্প্রতি হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ প্রতিবেদন দাখিল করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. মফিজুল ইসলাম।
র্যাব সদর দপ্তর, দেশের ৪৩ জেলার পুলিশ সুপার ও ৭ মহানগরের পুলিশ কমিশনারের দাখিল করা পৃথক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য মজুতকারীদের বিরুদ্ধে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী অবৈধভাবে মজুত করে বাজার যেন অস্থিতিশীল করতে না পারে সে বিষয়ে পুলিশি টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ ও সতর্ক রয়েছে।
র্যাব সদর দপ্তরের দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অবৈধভাবে মজুত করে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি বন্ধ প্রতিরোধে অবৈধ মজুতদারের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে র্যাব সারা দেশে পর্যাপ্ত টহল মোতায়েন করেছে এবং এ বিষয়ে র্যাব সবসময় সজাগ ও সতর্ক রয়েছে। র্যাবের সব ব্যাটালিয়নের আওতাভুক্ত এলাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
অবৈধ মজুতদারের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য র্যাবের গোয়েন্দা নিয়োগ করে তাদের চিহ্নিত করাসহ অভিযান অব্যাহত আছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৯ মে র্যাব-৩ যাত্রাবাড়ী থানাধীন এলাকায় বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তৈল অবৈধভাবে মজুত ও অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রির কারণে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক লাখ টাকা জরিমানা এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে পঞ্চাশ হাজার টাকাসহ সর্বমোট এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
গত ১১ মে সিপিসি-২, র্যাব ক্যাম্প নাটোর, র্যাব-৫, রাজশাহীর অধীনে নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম থানাধীন মৌখাড়া বাজারে মেসার্স নয়ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও সদর থানাধীন নিচা বাজারে কুন্ডু সাহা স্টোর, সোনালী স্টোর এবং স্টেশন বাজারে নিউ বেঙ্গল ট্রেডার্স এর গুদাম ঘর থেকে অবৈধ মজুত ৫ হাজার ৩৫৯ লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হয়। এরপর মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত মামলা নম্বর- ১৩৯, ১৪০, ১৪১, ১৪২, ১৪৩, ১৪৪/২০২১ ২০২২ (নাটোর) অনুযায়ী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর ৪০ ও ৪৫ ধারায় ছয় জন ব্যবসায়ীকে এক লাখ আটানব্বই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
১৩ সিপিসি-২, র্যাব ক্যাম্প নাটোর, র্যাব-৫, রাজশাহীর অধীনে নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম থানাধীন জোনাইল বাজাররে মোল্লা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, রুপম স্টোর, মিতা স্টোর, বিল্লাল স্টোর, মেসার্স দেবাশীষ স্টোরের গুদাম থেকে ৬ হাজার ৬০০ লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করে। পরে মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত মামলা নম্বর-১৪৬, ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ১৫০/২০২১-২০২২ অনুযায়ী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর ৩৮, ৪০ ও ৪৫ ধারায় পাঁচ জন ব্যবসায়ীকে তিন লাখ বিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়াও র্যাব এর অধীনে সব ব্যাটালিয়ন আওতাধীন এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের সব অবৈধ মজুতদারির বিষয়ে র্যাবের বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখা হয়েছে।
৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, খুলনা, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও জামালপুর-এই ৪৩টি জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য মজুতকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছেন।
এর মধ্যে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা জেলার আওতাধীন এলাকায় খাদ্য সামগ্রীর কোনো মজুতদার নেই। তারপরও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার এর সমন্বয়ে সংশ্লিষ্ট জেলাধীন বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। ঢাকা জেলাধীন এলাকায় কেউ যাতে খাদ্য সামগ্রী মজুত করতে না পারে সে বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। ঢাকা জেলাধীন এলাকায় অবৈধভাবে কোনো মজুতদার যদি খাদ্য সামগ্রী মজুত করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে যথারীতি অবহিত করা হবে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের করা রিট পিটিশনের নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, গাজীপুর, রংপুরের পুলিশ কমিশনারও প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
খুলনার পুলিশ কমিশনারের দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘খুলনা মহানগরী এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর মজুত রোধ সংক্রান্ত্র অনুসন্ধান ও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কোনো গোষ্ঠী বা সিন্ডিকেট যাতে ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী অবৈধভাবে মজুত করে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে সে বিষয়ে খুলনা মহানগরী এলাকার বিভিন্ন বাজারসহ সম্ভাব্য সব স্থানে পুলিশি টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, খুলনার নেতৃত্বে ৭০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ১৬৬টি মামলায় ১৬৬ জন ব্যক্তিকে দণ্ডিত করে ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৪০০টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পরিচালিত মোবাইল কোর্টগুলোতে কেএমপি প্রয়োজন অনুসারে ফোর্স মোতায়েন করে থাকে। খাদ্য সামগ্রীর মজুত বা মূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে দাখিল করা প্রতিবেদন ও এ সংক্রান্ত রুল শুনানির জন্য আগামী ১৬ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন আদালত।
গত ১৫ মার্চ সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য মজুতকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ সময় ওএমএস নীতিমালা অনুযায়ী সারাদেশে চাল, আটা, তেল, পেঁয়াজ, ডাল রেশন কার্ডের মাধ্যমে দিতে রুল জারি করেছেন আদালত। এছাড়া সয়াবিন তেল মজুত করার অভিযোগে আটকদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
গত ৬ মার্চ সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিং সেল গঠন এবং নীতিমালা তৈরি করতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনির হোসেন, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মহিদুল কবীর ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ উল্লাহ এ রিট দায়ের করেন। বাণিজ্য সচিব, ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়েছে।
এর আগে ৩ মার্চ সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন এ তিন আইনজীবী। তারা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন।
আদালত আইনজীবীদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় রিট করার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী রিট করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।