সময় বয়ে গেলে ছাপ রেখে যায়৷ নদী মরে গেলে যেমন দাগ রেখে যায়৷ বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল নির্বাচন অনেকটা ওই রকমই৷
অশুভ ছাপের৷ দগদগে দাগের৷ সময়ের ঘড়ি এবং নদীর স্রোত থমকে যায় যেন এখানে৷ এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল নির্বাচন যার সর্বশেষ উদাহরণ৷
ধরুন বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ, ধরা যাক সেই ১৯৯৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ, সেবারের দল নির্বাচনের চেয়ে এবারের এই দল নির্বাচনে পরিবর্তন কি হয়েছে খুব একটা?
আর নিয়তির কী প্রহসন, ২৩ বছর আগে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ যাত্রায় দল নির্বাচন বিতর্কের ভরকেন্দ্রে ছিলেন যে ক্রিকেটার, সেই মিনহাজুল আবেদীন নান্নুই কিনা এখন প্রধান নির্বাচক!
সেবার শুরুতে নান্নুকে রাখা হয়নি বিশ্বকাপ স্কোয়াডে৷ তাতে নির্বাচক প্যানেল পেরিয়ে তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ডেরও স্পষ্ট হস্তক্ষেপ ছিল৷ অথচ তখনও নান্নু বিবেচিত দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার হিসেবে৷ এ নিয়ে গণমাধ্যম ও গণমানুষে প্রবল প্রতিক্রিয়ার পর অবশেষে দলে নেয়া হয় তাকে৷ কপাল পোড়ে জাহাঙ্গীর আলমের৷ বিশ্বকাপ দলে থাকা এই ক্রিকেটারের জায়গায় নেয়া হয় নান্নুকে৷
এখন সেই নান্নু প্রধান নির্বাচক৷ কিন্তু দল নির্বাচনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের হস্তক্ষেপ কি কমেছে? বেড়েছে বরং৷
নির্বাচক প্যানেলের স্বাধীনতা কমে গেলে কাজের ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনাও কমে সত্যি৷ কিন্তু নিজেদের সেই কাজটিও কি ঠিকঠাক করতে পারছেন তারা? নান্নু তো প্রধান নির্বাচক; প্যানেলে আছেনও আরো আগে থেকে৷ জাতীয় দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারও নির্বাচক হিসেবে প্রায় এক যুগ৷ আবদুর রাজ্জাক রাজও যুক্ত হয়েছেন কিছু দিন হলো৷ কিন্তু দল নির্বাচনে তারা পরিকল্পনার ছাপ দেখাতে পেরেছেন কমই৷
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ স্কোয়াড থেকে যেমন ছেঁটে ফেলা হয়েছে মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদকে৷ পারফর্ম্যান্সের বিচারে গত বিশ্বকাপের পরই তো সেটি করা উচিত ছিল৷ কিংবা ধরুন কিছু দিন আগে এই ফরম্যাট থেকে অবসরের ঘোষণা দেয়া মুশফিকুর রহিমও৷ হ্যাঁ, গত বিশ্বকাপের পরের সিরেজে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাকে ‘বাদ’ দিয়েছিলেন নির্বাচকরা৷ বিশ্রামের মোড়কে৷ তা নিয়ে মুশফিকের কড়া প্রতিক্রিয়ায় পরের সিরিজেই আবার তাকে দলে ডাকা হয়। সেটি কতটা নির্বাচকরা ডেকেছেন, কতটা বিসিবির কারণে- ওই প্রশ্ন তো আছেই৷
এসবের ডামাডোলে দেখা যাচ্ছে, পরের বিশ্বকাপে ঠিক আগের সিরিজ এশিয়া কাপে মুশফিক-রিয়াদ থাকলেও বিশ্বকাপে নেই৷ অথচ অন্য সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশই দল নির্বাচনের পরিকল্পনা সাজায় এক বিশ্বকাপ থেকে আরেক বিশ্বকাপ ধরে ধরে৷
শুধু মুশফিক-রিয়াদ কেন, বিশ্বকাপের দল নির্বাচনে প্রশ্ন আছে আরো অনেক জায়গায়৷ যেমন কোনো ফরম্যাটে পারফর্ম না করেও নাজমুল হোসেন শান্তর সুযোগ পাওয়া৷ সেটিও ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে৷ অথচ এ বছর যে একটি মাত্র টি-টোয়েন্টি সিরিজে খেলেছেন এই বাঁহাতি, সেখানে ভূমিকা ছিল মিডল অর্ডার ব্যাটার হিসেবে!
কিংবা ধরুন সাব্বির রহমান বা সৌম্য সরকার৷ জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর কোনো পর্যায়ে ভালো না খেলেই ফিরেছেন তারা৷ সাব্বির বিশ্বকাপের মূল দলে; সৌম্য স্ট্যান্ড বাই তালিকায়৷ এই সৌম্যর ব্যাপারটাই আবার দেখুন না! ওপেনার, নাম্বার থ্রি, নাম্বার ফোর, ফিনিশার- কত কত ভূমিকায় নির্বাচকরা বিবেচনা করেন তাকে৷ আফিফ হোসেনকে কোন রোলে খেলাতে চায়, সেটিও যেন বড্ড অনিশ্চিত৷
তাহলে? ১৯৯৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে ধরলেও দল নির্বাচন প্রক্রিয়া ঘুরপাক খাচ্ছে সেই অপেশাদারিত্বের গোলকধাঁধায়৷
২৩ বছর আগে নান্নুর কারণে যার বিশ্বকাপ খেলা হয়নি, সেই ওপেনার জাহাঙ্গীর আলম একদার সতীর্থের বর্তমান অবস্থাটা বুঝছেন, এখন নান্নু ভাই একলা দল বানান না৷ পেছনে আরো অনেক লোক আছে৷ অন্য দুই নির্বাচক আছে৷ টিম ডিরেক্টর আছে৷ বোর্ডের কর্মকর্তারা আছেন৷ এখন অনেকে মিলেই এই দল তৈরি করে৷ নিজেদের সময়ের সঙ্গে একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন সাবেক এই কিপার-ব্যাটার৷ আর রিয়াদকে বিশ্বকাপ দলে সুযোগ দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন বাংলাদেশের জার্সিতে তিনটি ওয়ানডে খেলা জাহাঙ্গীর, পরিবর্তন তো অনেক কিছু হয়েছে৷ এখন অনেক প্লেয়ার আছে; আগে এত প্লেয়ার ছিল না৷ এখন রিয়াদের বদলে অন্য একজনকে নিয়েছে৷ রিয়াদকে বিশ্বকাপ খেলিয়ে বিদায় দেয়া উচিত ছিল৷ আর যদি নাই নেবে, তাহলে বিশ্বকাপের আগের অনুশীলনে ডাকাই উচিত হয়নি৷
জাতীয় দলের আরেক সাবেক ক্রিকেটার তারেক আজিজ খানের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ পুরো দল নির্বাচন প্রক্রিয়াই, সত্যি বলতে কি, আমাদের দল নির্বাচন একটা গৎবাঁধা ব্যাপারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, আমাদের সিলেকশন প্যানেল সেভাবে কাজ করতে পারে না৷ একটা অদৃশ্য ছায়ার কারণে সবসময়ই ঝামেলা হয়৷ প্রধান নির্বাচক যখন বলবেন, সবার সম্মতিক্রমে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এর অর্থ নিজেদের সক্রিয় ভাবনা প্রয়োগ করার ক্ষমতা তাদের নেই৷ সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলে তো আর নির্বাচকদের দরকার নেই৷ তাহলে উনাদের রেখে লাভ কী? মাসে মাসে বেতন তাহলে অপাত্রে যাচ্ছে৷
নান্নু-সুমন-রাজ্জাকের নির্বাচক প্যানেল যে প্রবল চাপের মধ্যে থাকেন, সেটি মানছেন তারেক৷ কিন্তু সেটি নিজেদের তৈরি বলে দাবি বাংলাদেশের জার্সিতে ৩ টেস্ট ও ১০ ওয়ানডে খেলা সাবেক এই পেসারের, নির্বাচকদের কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়, তারা কী পরিমাণ চাপে থাকে৷ এই চাপ তো তারাই তৈরি করেছেন৷ অগোছালো কাজ করলে চাপে থাকবেন না৷ তারা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী না৷ যদি সততা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কি নিজের কাজের পক্ষে আপনি জোর গলায় বলতে পারবেন? নিজস্ব সততা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে ব্যক্তিত্বও থাকছে না৷
নির্বাচকদের অসহায় মানছেন তারেক৷ কিন্তু সেজন্য কোনো সহানুভূতি নেই তার, নির্বাচকদের তো আমরা দূর থেকে দেখি৷ তবে মিডিয়ার সামনে তাদের যে কর্মকাণ্ড দেখি, তাতে মনে হয় উনারা অসহায়৷ মনে হয়, নির্বাচকরা সব কাজ করে অপেক্ষা করেন নিজেদের কাজের বৈধতা নেবার জন্য৷ এটা স্পষ্ট যে, স্বাধীনভাবে তারা কাজ করছেন না৷ নিজস্ব মতামত প্রয়োগ করার জায়গা তারা পাচ্ছেন না৷ তারাও তালে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন৷
বিসিবির কারণে না হয় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না, কিন্তু খেলোয়াড় বাছাইয়ের কাজটাও কি ঠিকঠাক করতে পারছেন নির্বাচক প্যানেল? এখানেও নান্নুর নেতৃত্বাধীন প্যানেলকে ছাড় দেবার কোনো অবকাশ দেখেন না তারেক, আমাদের খেলোয়াড় আগে যা ছিল, এখনও তাই আছে৷ গত ১০ বছরেও আমাদের নির্বাচকরা নতুন কাউকে আনতে পারেননি৷ এখানে যা হচ্ছে, সব ইন্সট্যান্ট৷ ধাপে ধাপে তৈরি করে নিয়ে এসে খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না৷ যে কোনো কিছুতেই দেখতে পাচ্ছি, একজনের মতামত ছাড়া কিছু হচ্ছে না৷ কোনটা রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড, কোনটা ডেভেলপমেন্ট প্রসেস, সে কাজগুলোর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা না নিয়ে এলে খেলোয়াড় বের করতে পারবেন না৷
বোর্ডের হস্তক্ষেপে কুঁকড়ে থাকা, নিজেদের কাজে দক্ষতার অভাব, যার শেষ পরিণতি বাজে ফল ভোগ করে জাতীয় দল৷ বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনাদিকাল থেকেই নির্বাচকদের এ অবস্থার পরিবর্তন হয়নি৷ ‘সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না’ -বইয়ের প্রবাদটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই জায়গায় এসে থমকে যায়৷ স্থবির হয়ে যায়৷ দল নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি যে বদলায়নি এতটুকুন!