ওষুধের দাম শতভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও ওষুধ উৎপাদনকারীরা বলছেন, তাদের লোকসান এখনো কাটেনি। তারা বলছেন, দাম বাড়ানোটা ছিল সময়ের দাবি। ওষুধ উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক কিছুর দাম বেড়েছে কিন্তু অনেক দিন ধরে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের দাম আগের মতোই ছিল। ফলে লোকসানের সম্মুখীন না হতে কিছু কিছু ওষুধ কোম্পানি কিছু অত্যাবশ্যকীয় তালিকার ওষুধ উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছিল। তারা বলছেন, তেল ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে দেশে অনেক নিত্যপণ্যের দাম রাতারাতি বেড়ে গেছে। তেল ও ডলারের দামের সাথে ওষুধ কোম্পানিগুলো সরাসরি সংশ্লিষ্ট। কিন্তু ওষুধের দাম রাতারাতি বাড়ানো হয়নি।
ওষুধ কোম্পানির একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, জ্বালানি তেলের সাথে ওষুধ কোম্পানি সরাসরি সংশ্লিষ্ট। ওষুধ উৎপাদনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন। যে হারে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে, তাতে প্রতিটি ওষুধ কারখানায় পাওয়ারফুল জেনারেটর স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়। তিনি বলেন, লোডশেডিংয়ের জন্য তার কোম্পানির মাসে ১৫ হাজার লিটার তেল বেশি লাগছে। আগে ৮০ টাকা লিটারে ডিজেল কেনা যেত এখন সেই ডিজেল কিনতে হয় ১১৪ টাকা লিটারে। ডিজেলের দাম বাড়ার সাথে সাথে মাসে এখন ১৫ হাজার লিটার ডিজেল বেশি লাগছে লোডশেডিংয়ের কারণে।
অন্য দিকে আগে ডলার পাওয়া যেত ৮৪-৮৫ টাকায়। এখন ১১০ টাকার বেশি দিয়ে ডলার কিনতে হয়। মাঝখানে ১২০ টাকা দিয়েও ডলার পাওয়া যায়নি। ডলারের বর্ধিত দামের কারণে ওষুধের দাম বাড়াতে হয়েছে।
ওষুধ কোম্পানির ওই ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনের অনেক কিছুই চীনের ওপর নির্ভরশীল। ওষুধের অনেক কাঁচামাল (এপিআই) এখন ভারত থেকে আনা হয়। কিন্তু ভারতীয়রা এপিআই উৎপাদনের কাঁচামাল আনে চীন থেকে। চীনে পরিবেশ দূষণ রোধে অনেক কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে সেখানে বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। সে দামের সাথে ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামালের দামও চীনারা বাড়িয়েছে। ফলে ভারত থেকে এপিআইও কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। এ ছাড়া শিপমেন্টের খরচও বেড়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর। এই শিপমেন্টের সাথে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প সরাসরি জড়িত। প্রতিটি শিপমেন্টের খরচ বেড়ে গেলে এর সাথে ওষুধের দাম বেড়ে যায়। এত দিন অনেক ওষুধের দাম বাড়েনি, ফলে ওষুধ শিল্পের মালিকরা অব্যাহত লোকসান দিয়ে যাচ্ছিল।
তিনি বলেন, ওষুধের সাথে প্যাকেজিং শিল্পও সরাসরি জড়িত। গত দুই বছর ধরে প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়ালের দাম শুধুই বাড়ছে। কাগজ, কালি, প্যাকেজিং করার মেটেরিয়াল, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, ব্লিস্টারের দাম যে করোনার সময় বেড়েছে তা আর কমেনি।
তিনি জানান, ওষুধ উৎপাদনের সাথে সব কিছুর দাম বাড়ায় কেবল প্যারাসিটামলের পেছনে কোনো কোনো কোম্পানি ৫ শতাংশ করে লস দিচ্ছিল। তিনি বলেন, তার মধ্যমসারির কোম্পানি হওয়ায় তিনি প্যারাসিটাল উৎপাদনে সাড়ে ৬ শতাংশ করে লোকসান গুনছিলেন। ওষুধ শুধু উৎপাদন করলেই হয় না, এটা ফার্মেসি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হয় ওষুধ কোম্পানির নিজের গাড়ি করে। পৌঁছে দেয়ার পরও ফার্মেসি মালিককে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হয়, এটা তাদের ব্যবসা।
তিনি বলেন, আগে ওষুধ বিদেশে রফতানি করে মালিকরা লোকসান পুষিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি ওষুধ রফতানি হয়ে থাকে সেসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। ফলে তারা ওষুধ কেনা কমিয়ে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ক্যাম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ওষুধ আমদানি করত। কিন্তু করোনা অথবা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে এই দেশগুলো এখন বিপর্যস্ত। ফলে ওষুধ রফতানিতেও এর প্রভাব পড়েছে।
ওষুধের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এই প্রবৃদ্ধিতে ভাটা পড়েছে। বলা হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পেও চলছে বিপর্যস্ত অবস্থা।
ওষুধের দাম বাড়ার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যেভাবে ওষুধের দাম বাড়ে এটা যৌক্তিক না। এটাকে আরো হিসাব-নিকাশ করে, একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে দাম বাড়ানোর ব্যাপারটি ন্যস্ত করতে হবে। তারা যৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানোর ব্যাপারটি দেখবেন।’