বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে লাল-সবুজের মাঝে সাদা রঙের ২০ সেট ডিজেল-ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট অর্থাৎ ডেমু ট্রেন যুক্ত হয়েছিল ২০১৩ সালে। দু’দিকে ইঞ্জিন আর মাঝে একটি ক্যারেজের দৃষ্টিনন্দন ট্রেনগুলো দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। তবে, বছর পাঁচেক না যেতেই চীনা প্রযুক্তির দৃষ্টিনন্দন ট্রেনগুলো মানুষের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। স্থান হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওয়ার্কশপে। অবশেষে ট্রেনগুলো আবারও মানুষের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
মূলত, ডেমু ট্রেন মেরামতের জন্য ওয়ার্কশপ না থাকা, এতে ব্যবহার করা মডিউলের সফটওয়্যার সেটআপ দেওয়া সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকাসহ নানা কারণে ২০১৩ সালে চালু হওয়ার পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ২০১৮ সাল থেকে একটার পর একটা অকেজো হতে থাকে ডেমু ট্রেন। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ে চীনা প্রযুক্তির ডেমু ট্রেনগুলো চালুর উদ্যোগ নিলে দেখা যায় যে পরিমাণ টাকা দিয়ে ট্রেনগুলো কেনা হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই তখন কিছুটা পিছপা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে, সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে ২০২২ সালে এসে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী ট্রেনগুলোকে সচল করতে দেশীয় প্রকৌশলীদের শরণাপন্ন হন। এগিয়ে আসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও আনবিক শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান।
খোলস ঠিক রেখে দেশীয় প্রযুক্তিতে ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম বদলে আবারও সচল করা হয়েছে অকেজো একটি ট্রেন। এতে নতুন সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ইতোমধ্যে ডেমু ট্রেনের একটি সেট সম্পূর্ণভাবে ট্রায়াল রান শেষ করে পার্বতীপুরে প্রস্তুত হয়েছে যাত্রী পরিবহনের জন্য। খুব শিগগিরই এটি যাত্রী পরিবহনের বহরে যুক্ত হবে
তিনি ডেমু ট্রেন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। মাত্র দেড় বছরের চেষ্টায় চীনা প্রযুক্তি ফেলে, দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ডেমু ট্রেন সচলও করেন। আসাদুজ্জামানকে সহযোগিতা করেন, প্রকৌশলী আজিম বিশ্বাসসহ পার্বতীপুর ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
খোলস ঠিক রেখে দেশীয় প্রযুক্তিতে ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম বদলে আবারও তারা সচল করেন অকেজো একটি ট্রেন। এতে নতুন সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ইতোমধ্যে ডেমু ট্রেনের একটি সেট সম্পূর্ণভাবে ট্রায়াল রান শেষ করে পার্বতীপুরে প্রস্তুত হয়েছে যাত্রী পরিবহনের জন্য। খুব শিগগিরই এটি যাত্রী পরিবহনের বহরে যুক্ত হবে— প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে দুটি ডেমু ট্রেন ঢাকায় এবং তিনটি চট্টগ্রামে চালু আছে। ট্রেন দুটি আংশিক সংস্কার করেই চালানো হচ্ছে। বাকি ১৪টি ডেমু ট্রেনের কী হবে— এমন প্রশ্ন এখন সবার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অকেজো একটি ডেমু ট্রেন থেকে চীনা প্রযুক্তি ফেলে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এখন সেটি যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রস্তুত। বর্তমানে সেটি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। বাকি ডেমু ট্রেনগুলোর মূল্যায়ন করা হচ্ছে। মূল্যায়ন শেষে প্রস্তাব আকারে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারা অনুমোদন দিলে ট্রেনগুলোর সংস্কার কাজ শুরু হবে।
কেন অকেজো হয়েছিল ডেমু ট্রেনগুলো
কাছাকাছি দূরত্বে বেশি যাত্রী পরিবহনের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০টি ডেমু ট্রেন আমদানি করে সরকার। চীনের তানশাং ইন্টারন্যাশনাল ও ডানিয়াল টেকনিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে ট্রেনগুলো কেনা হয়। ওই সময় ডেমু ট্রেনগুলো মেরামতের জন্য দেশে কোনো ওয়ার্কশপ ছিল না। সেগুলো ছিল খুবই নতুন এবং জটিল প্রযুক্তির। বিশেষ করে এর ইলেকট্রিক্যাল অংশটা ছিল জটিল সফটওয়্যার বেইজড। প্রতিটা ডেমুতে প্রায় ৩০-৩৫টা মডিউলের ব্যবহার ছিল। সবগুলো মডিউল ছিল প্রোগ্রামেবল এবং দামি।
ডেমু রক্ষণাবেক্ষণ করতে এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। তাদের কাছ থেকে প্রোগ্রাম এনে যন্ত্রাংশ লাগাতে হতো। খোলা বাজারে আপনি সেই যন্ত্রাংশ পাবেন না। যদিও পান, সেগুলো কাজে আসবে না। এর মডিউল থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক কম্পনেন্টগুলো খুবই দামি। এভাবে যদি খরচ করতে হয়, তাহলে ডেমু কেনার চাইতে এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেশি পড়ে যায়
ডেমু ট্রেনগুলো অকেজো হওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চোখের সামনে আমদানির পাঁচ বছরের মাথায় ডেমু ট্রেনগুলো অকেজো হতে থাকে। কারণ, এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়, যা করা হয়নি। কয়েক বছর পরপর ওভারহোলিং করতে হয়, সেটাও করা হয়নি। এছাড়া ডেমু রক্ষণাবেক্ষণ করতে এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। তাদের কাছ থেকে প্রোগ্রাম এনে যন্ত্রাংশ লাগাতে হতো। খোলা বাজারে আপনি সেই যন্ত্রাংশ পাবেন না। যদিও পান, সেগুলো কাজে আসবে না। এর মডিউল থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক কম্পনেন্টগুলো খুবই দামি। এভাবে যদি খরচ করতে হয়, তাহলে ডেমু কেনার চাইতে এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেশি পড়ে যায়।’
আগে ডেমুতে দুই সেট বড় ব্যাটারি ব্যবহার করা হতো, যার মাধ্যমে ট্রেনটি কন্ট্রোল হতো। এটি চলত জেনারেটরে। দুই সেট ব্যাটারির দাম ছিল ১০ লাখ টাকা। তাও লোকাল মার্কেটে পাওয়া যেত না। আমরা তার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকায় লোকাল মার্কেট থেকে ব্যাটারি সংগ্রহ করি এবং সেগুলো লাগাই। এখন ট্রেনটি আগের গতিতেই চলছে
প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান, ডেমু ট্রেন সংস্কারক
‘দায়িত্বে আসার পর মনে হলো আমাদের তো হিস্ট্রিতে এমন কিছু নাই যে এত অল্প সময়ে কোনো রোলিং স্টক এভাবে নষ্ট হয়ে যায়। কারণ, আমরা লোকোমোটিভ মেইনটেনেন্স (রক্ষণাবেক্ষণ) করি, ক্যারেজ মেইনটেনেন্স করি। দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ডেমু ট্রেনগুলো নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করি। পরে মাথায় এলো, দেশীয় প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে এগুলো চালানো যায় কি-না। এর অংশ হিসেবে ট্রেন সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার মো. আসাদুজ্জামানের ওপর।’
যেভাবে সচল হলো ডেমু ট্রেন
প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডেমু ট্রেনগুলোর কোয়ালিটি খারাপ ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশে ট্রেনগুলো যারা পরিচালনা করবেন বা বুঝে নেবেন, সেই মানুষগুলোর অভাব ছিল। যতদিন ওদের (চীনা কোম্পানি) সঙ্গে চুক্তি ছিল, ততদিন ভালোভাবে চালু রাখা গেছে। চুক্তি শেষে ওরা চলে যাওয়ার পর একটা একটা করে সবগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে। কী কারণে নষ্ট হয়েছে, সেটাও বলতে পারেন না রেলওয়ের লোকজন। শুধু জানেন, ট্রেন চলে না।
‘ট্রেনগুলোর সবকিছুই সফটওয়্যার বেইজড। কোনো একটা যন্ত্রাংশ কিনলে সেটা কম্পিউটার সফটওয়্যার দিয়ে কনফিগার করে তারপর লাগাতে হয়। ওই কনফিগার করার সফটওয়্যার চীনা কোম্পানি দিয়ে যায়নি। বাংলাদেশ রেলওয়েও তা চেয়ে রাখেনি।’
ডেমু ট্রেনটির ক্যাপাসিটি ছিল ৩০০ যাত্রীর, আমরা এখন ৭২০ যাত্রী নিয়ে ট্রায়াল করেছি। এখন তারা (বাংলাদেশ রেলওয়ে) যদি অনুমতি দেয়, তাহলে বাকিগুলোর কাজ শুরু করতে পারব। বাকি ১৪টির কাজ শেষ করতে দুই মাস সময় লাগতে পারে। কারণ, আগের ট্রেনটির ট্রায়াল রান শেষে আমরা বুঝে গেছি কোথায় কোন জিনিস লাগবে
প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান, ডেমু ট্রেন সংস্কারক
‘চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে পার্বতীপুরের ডিজেল ওয়ার্কশপে একটি ডেমু ট্রেনের সংস্কার কাজ শুরু করি। আমরা তাদের প্রযুক্তি বাদ দিয়ে দেশীয় প্রযুক্তি কাজে লাগাই। ফলও পাই, সেটি চালু করতে সক্ষম হই। আমরা যেসব যন্ত্রাংশ সেখানে লাগিয়েছি, তা দেশীয় মার্কেট থেকে পাওয়া। আগে ডেমুতে দুই সেট বড় ব্যাটারি ব্যবহার করা হতো, যার মাধ্যমে ট্রেনটি কন্ট্রোল হতো। এটি চলত জেনারেটরে। দুই সেট ব্যাটারির দাম ছিল ১০ লাখ টাকা। তাও লোকাল মার্কেটে পাওয়া যেত না। আমরা তার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকায় লোকাল মার্কেট থেকে ব্যাটারি সংগ্রহ করি এবং সেগুলো লাগাই। এখন ট্রেনটি আগের গতিতে চলছে।’
‘গত ৪ সেপ্টেম্বর ট্রায়াল রান শেষে ডেমু ট্রেনটি বাংলাদেশ রেলওয়েকে বুঝিয়ে দিয়েছি’— উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ডেমু ট্রেনটির ক্যাপাসিটি ছিল ৩০০ যাত্রীর, আমরা এখন ৭২০ যাত্রী নিয়ে ট্রায়াল করেছি। এখন তারা (বাংলাদেশ রেলওয়ে) যদি অনুমতি দেয়, তাহলে বাকিগুলোর কাজ শুরু করতে পারব। বাকি ১৪টির কাজ শেষ করতে দুই মাস সময় লাগতে পারে। কারণ, আগের ট্রেনটির ট্রায়াল রান শেষে আমরা বুঝে গেছি কোথায় কোন জিনিস লাগবে।’
একটি ডেমু ট্রেন ঠিক করতে কেমন খরচ হয়েছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। কারণ, একেক ডেমুর এককে সমস্যা। কোনোটায় কম খরচ হবে, আবার কোনটায় বেশি— এটাই স্বাভাবিক। তবে এতটুকু বলতে পারি, ১০ ভাগের এক ভাগ খরচ হবে।’
মন্ত্রণালয় (রেলপথ মন্ত্রণালয়) যদি আমাদের মডিফাইড টেকনোলজিতে সবগুলো ডেমু সচলের অনুমতি দেয় তাহলে আমরা কাজ শুরু করব। বলতে পারেন, বাকি ১৪টি ডেমু এখন অনুমতির অপেক্ষায় আছে
বাকি ১৪টি ডেমু ট্রেনের ক্ষেত্রে কী ভাবনা রেলওয়ের— জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের মোট ছয় সেট ডেমু এখন সচল আছে। পাঁচটির মেকানিক্যাল পার্টে কিছু সমস্যা ছিল। সংস্কার করে সেগুলো এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলছে। পার্বতীপুরে আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে সংস্কার করে গত ৪ সেপ্টেম্বর ট্রায়াল রান শেষ করেছে একটি। মন্ত্রণালয়ে আমরা চিঠি দিয়েছি যেন টাইম শিডিউল করে ট্রেনটিকে নিয়মিত চালানো হয়। এর আগে এটিকে আমরা অবজারভেশনে রাখব। পাশাপাশি বাকিগুলোর অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) শুরু করে দিয়েছি। অ্যাসেসমেন্ট শেষে প্রপোজাল আকারে আমরা মন্ত্রণালয়ের সাবমিট করব।’
‘মন্ত্রণালয় (রেলপথ মন্ত্রণালয়) যদি আমাদের মডিফাইড টেকনোলজিতে সবগুলো ডেমু সচলের অনুমতি দেয় তাহলে আমরা কাজ শুরু করব। বলতে পারেন, বাকি ১৪টি ডেমু এখন অনুমতির অপেক্ষায় আছে।