রাজনীতি কি মরণ খেলা?

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


আগামী নির্বাচনের এখনো অন্তত ১৬ মাস বাকি। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং মাঠের প্রধান বিরোধী দল মাঠের দখল নিতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে। বিএনপির সকল চেষ্টা আগামী নির্বাচন ঘিরেই।

তবে বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি। বরং তারা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটল। কিন্তু সরকারি দল স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখন আর সংবিধানে নেই। আর আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই।

বিএনপি জানে, তারা দাবি করলেই সরকারি দল সেটা মেনে নেবে, ব্যাপারটা অত সরল নয়। ভবিষ্যতের কোনো আলোচনার টেবিলে দর কষাকষিতে সুবিধা পেতে মাঠের দখল থাকাটা জরুরি। তাই বিএনপি আগেভাগেই মাঠের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তবে আওয়ামী লীগ সহজেই মাঠ ছেড়ে দেবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং মাঠের রাজনীতিতে বরাবরই আওয়ামী লীগ, অন্তত বিএনপির চেয়ে এগিয়ে থাকে।

আগামী নির্বাচন হতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। আওয়ামী লীগের পক্ষেও দুটি নির্বাচনের মতো বিএনপিকে বাইরে রেখে বা কোণঠাসা রেখে নির্বাচন করা কঠিন। আবার বিএনপির পক্ষেও আগের দুটি নির্বাচনের মতো বর্জন করা বা নামকাওয়াস্তে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়।

একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এখন সবার আকাঙ্ক্ষা। কে ক্ষমতায় আসবে, সেই সিদ্ধান্ত যেন জনগণ নিতে পারে। টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির জন্য অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি করেছে। দলটি তাদের ৪৪ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে। কিন্তু এখনকার মতো অস্তিত্বের সঙ্কটে কখনো পড়েনি।

আওয়ামী লীগ ২১ বছর পরও দাপটের সাথে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পেরেছিল তাদের তৃণমূলে বিস্তৃত সাংগঠনিক সক্ষমতার জোরে। বিএনপির জনসমর্থন থাকলেও সংগঠন তত মজবুত নয়।

বিএনপি এখন তাই মাঠে নেমেছে অস্তিত্বের লড়াইয়ে। আর মাঠে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার, সভা-সমাবেশ করার অধিকার সংবিধানেই স্বীকৃত। আবার সরকারি দল নির্বিঘ্নে বিরোধী দলকে মাঠ দখল করতে দেবে, এতটা গণতান্ত্রিকও আমরা হয়ে উঠতে পারিনি।

তবে জাতীয়-আন্তর্জাতিক চাপে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক গণতান্ত্রিক আচরণ করবে, এমনটা প্রত্যাশিত ছিল। এটা অনেকটা টোপের মতোও বটে-বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দিয়ে গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি করে তাদের নির্বাচনে আনার মতো পরিবেশ তৈরি করা।

প্রধানমন্ত্রী ইদানীং একাধিক অনুষ্ঠানে বিরোধী দলকে নির্বিঘ্নে আন্দোলন করতে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে এলেও তাদের বাধা না দিয়ে চা খাওয়ানোর কথাও বলেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর এই বার্তা মাঠ পর্যায়ে ঠিকভাবে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না।

বরং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘খেলা হবে’ ঘোষণাকেই কর্মীরা গ্রহণ করেছেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই নিজেদের মাঠের পুরোনো খেলোয়াড় দাবি করেছে।

ওবায়দুল কাদের মাঠে থেকেই প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা আর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং গায়ের জোরে মাঠ দখলে রাখা এক কথা নয়।

আওয়ামী লীগ নেতারা অনানুষ্ঠানিকভাবে বলছেন, শোকের মাস আগস্টে বিএনপিকে মাঠ ছেড়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আগস্ট মাসে বিএনপিকে মাঠে নামানোর দায় অনেকটাই সরকারের।

জুলাই মাসের শেষ দিনে ভোলায় পুলিশের গুলিতে দুই নেতাকর্মীর মৃত্যু এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়ায় বিএনপি মাঠে নামার ইস্যু পেয়ে যায়। তবে বিএনপি আত্মবিশ্বাস পেয়েছে মাঠ থেকেই। ১০ আগস্ট নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিশাল সমাবেশ তাদের উজ্জীবিত করেছে।

আবার বিএনপির সমাবেশে সাধারণ মানুষের বিপুল উপস্থিতি শঙ্কিত করেছে সরকারি দলকেও। সেই সমাবেশ থেকেই দুই দলের মাঠ দখলে রাখার চেষ্টা প্রবল হয়। সেই সমাবেশ থেকেই ভোলায় দুই নেতা হত্যা এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ২২ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি।

আর এই বিক্ষোভ ঘিরেই দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বিএনপি প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। পুলিশের পাশাপাশি সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। অনেক জায়গায় সরকারি দল পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে ১৪৪ ধারা ডেকে এনে বিএনপির কর্মসূচি পণ্ড করেছে।

তবে আগের মতো বিএনপি এবার মাঠ ছাড়েনি। প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দ্বিমুখী আক্রমণেও মাঠ আঁকড়ে থাকার চেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। কোথাও কোথাও তারা প্রতিরোধ গড়ারও চেষ্টা করেছে। বিরোধী দলের প্রতি সরকার ও সরকারি দলের এই মারমুখী আচরণ ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়।

মাঝখানের দুই বছর বিএনপির পেট্রোল সন্ত্রাসের বিষয়টি বাদ দিলে আওয়ামী লীগের ১৩ বছরের শাসনামলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল, রাজপথ ছিল শান্ত। আর এই স্থিতিশীলতার সুবাদে এসেছে অর্থনৈতিক অগ্রগতি।

মানুষও এই স্থিতিশীলতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তারা আর কোনোভাবেই হানাহানি, সংঘাত, হরতাল, অবরোধের রাজনীতিতে ফিরে যেতে চায় না। কিন্তু কেউ যদি নতুন করে ছড়িয়ে পড়া রাজনৈতিক সংঘাত আর সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতার জন্য বিএনপিকে দায়ী করতে চান, কেউ যদি মনে করেন বিএনপি কর্মসূচি দিয়েছে বলেই সংঘাত হচ্ছে; তাহলে সেটা অন্যায় হবে।

বিএনপি একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। নির্বাচন সামনে রেখে তারা মাঠে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করতেই পারে। আর পুলিশ গুলি করে তাদের নেতাকর্মীদের মেরে ফেললে, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে তারা প্রতিবাদ করবেই। সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারও তাদের আছে।

বর্তমান অস্থিরতায় বরং সরকারি দলের দায় বেশি। মাঠ দখলে রাখা মানে প্রতিপক্ষের সমাবেশে হামলা করা নয়। বিএনপির সমাবেশের কাউন্টার হিসেবে আওয়ামী লীগ তারচেয়ে বড় সমাবেশ করতে পারে, আরও বড় মিছিল করে নিজেদের শক্তি দেখাতে পারে।

গায়ের জোরে প্রতিপক্ষ দমনের চেষ্টা কোনো কাজের কথা নয়। আর সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বও বেশি। নিজেদের স্বার্থেই তাদের রাজপথ স্থিতিশীল রাখতে হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এমনিতে অর্থনীতি প্রবল চাপের মুখে আছে। নতুন করে রাজপথে অস্থিতিশীলতা নেওয়ার মতো সক্ষমতা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির নেই। রাজনীতিবিদরা মাঠ দখলের যে খেলায় মেতেছেন, সেটা তাদের জন্য খেলা হতে পারে; কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তা মৃত্যুসম।

আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। মানুষের প্রতিবাদ করার, রাজপথে বিক্ষোভ করার অধিকার চাই। কিন্তু কোনোভাবেই আর হানাহানি, সংঘাত, হরতাল, অবরোধের রাজনীতিতে ফিরে যেতে চাই না।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *