জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি বলেছেন, ‘প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে যারা অন্যায়ভাবে স্বৈরাচার উপাধি দিয়েছে, তারাই ১৯৯০ সালের পর সংবিধানে কাটাকাটি করে স্বৈরতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বারবার সংবিধান সংশোধন করে দেশে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশে আজ এক ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা, তিনি যা বলবেন সেটাই আইন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা কখনোই গণতন্ত্র হতে পারে না। এভাবে গণতান্ত্রিক চর্চাও হতে পারে না। এক ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা থাকলে গণতন্ত্র চর্চা সম্ভব নয়। পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অনেক মিথ্যাচার করেছে কিন্তু সফল হয়নি। দেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় পল্লীবন্ধু অক্ষয় হয়ে আছেন। এখন রাজনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে- গণতন্ত্র নিপাত যাক আর স্বৈরতন্ত্র চালু থাক।’
শনিবার জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় মিলনায়তনে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায় প্রণীত ‘ছোটদের পল্লীবন্ধু’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জিএম কাদের এসব কথা বলেন।
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা এবং জাতীয় পার্টি রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট উইংয়ের আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম মিলন এতে সভাপতিত্ব করেন। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির আহ্বায়ক শেরিফা কাদের এমপি।
অনুষ্ঠানে লালমনিরহাটের বিশিষ্ট সমাজসেবক এমজি গোলাম ও ব্যাংকার এএএম ওয়াহেদুল ইসলাম জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের হাতে ফুল দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন।
জিএম কাদের এ সময় আরও বলেন, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ছোট করতে অসংখ্য মিথ্যাচার করেছে প্রতিপক্ষরা। তারা পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দুর্নীতিবাজ বলে মিথ্যাচার করেছে। কিন্তু ক্লিনহার্ট এবং ওয়ান ইলেভেনের সময় দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে পল্লীবন্ধু বা জাতীয় পার্টির কোনো নেতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। আবার ১৯৯০ সালে যে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকার জন্য পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দণ্ডিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আদালতই রায় দিয়েছেন ওই টাকা জাতীয় পার্টির দলীয় টাকা। সেই টাকা জাতীয় পার্টিকে ফেরত দিতে নির্দেশও দিয়েছেন আদালত।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ৯০ সালের পর থেকে ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি করছে। ক্ষমতা হারালে প্রতিপক্ষ দুর্নীতির মামলা দেয়। পরবর্তীতে ক্ষমতায় গিয়ে সেই মামলা তুলে ফেলেন। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে দুর্নীতির যে মামলাগুলো হয়েছিল ক্ষমতায় এসে তারা সেই মামলাগুলো তুলে ফেলেছে। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় যেতে না পেরে তাদের নামের মামলাগুলো তুলতে পারেনি।’
জিএম কাদের প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এখন দেশে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। দুর্নীতি দেশের রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু অর্ধেকটা উদ্বোধন হয়েছে কিন্তু এখনো রেলসেতু চালু হয়নি। পদ্মা সেতুতে বিদেশি ঋণ আছে, এটি নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হয়নি। পদ্মায় রেলসেতু উদ্বোধন করতে আরও অনেক অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে হবে।’
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান বলেন, ‘পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক নেতা। তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করেছেন, কিন্তু সব ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের জন্য পৃথক কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন, শুভ জন্মাষ্টমিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। চাকরি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের বৈষম্য দূর করেছিলেন পল্লীবন্ধু। হিন্দু সম্প্রদায়সহ সব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন পল্লীবন্ধু।’
তিনি বলেন, ‘গবেষণায় উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগের হাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বেশি জমিজমা দখল হয়েছে। আবার বিএনপির হাতেও দখল হয়েছে সংখ্যালঘুদের জমিজমা। গ্রামাঞ্চলে এখনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতিত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের হাতে।’
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন একজন জননন্দিত নেতা। তার মৃত্যুতে চারটি জনসভায় লাখো মানুষের সমাগম প্রমাণ করে তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৯০ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করেছে।’
অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘ইতিহাস থেকে পল্লীবন্ধু এরশাদকে মুছে ফেলা যাবে না। ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ হয়েছে। পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশের উন্নয়ন, সংস্কার আর মানবিকতার ইতিহাসে উজ্জল তারকা হয়ে থাকবেন। এদেশের উন্নয়নে পল্লীবন্ধুর কীর্তির মাঝে অসংখ্য ব্রিজ রয়েছে। তিনি যমুনা সেতু ও পদ্মা সেতু নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন।’
কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি বলেন, ‘দেশে ইতিহাস বিকৃতি চলছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি তারাই ইচ্ছামতো এবং মনগড়া তথ্য দিয়ে ইতিহাস লিখছে। বর্তমান বাস্তবতায় ছোটদের পল্লীবন্ধু বইটি শুধু কোমলমতি শিশু নয়, বড়দের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এই বইটি পড়ে পল্লীবন্ধুর ঐতিহাসিক জীবনের কিছু ছবি দেখতে পাবে সবাই।’
কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, ‘পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উন্নয়ন এখনো দেশের মানুষ মনে রেখেছে। দেশের মানুষ আবারো পল্লীবন্ধুর স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে চায়। পল্লীবন্ধুর লাঙ্গল নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যাব। আমরা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করব।’
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য শাহীনারা সুলতানা রীমার সঞ্চালনায় এ সময় আরও বক্তব্য দেন- জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা, ফখরুল ইমাম এমপি, সুনীল শুভ রায়, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, সোলায়মান আলম শেঠ, আতিকুর রহমান আতিক, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা শেরিফা কাদের এমপি, মনিরুল ইসলাম মিলন।