সাগরে ট্রলার ডুবিতে স্বামী সাইফুল ইসলামকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্ত্রী পারভিন আক্তার। তার আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে আশপাশের পরিবেশ। সাইফুলের মা নাছিমা খাতুন ও বাবা গুরা মিয়াও ছেলের শোকে পাগলপ্রায়।
কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাদের কান্না। পাড়া-প্রতিবেশিরাও তাদের আহাজারিতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। রোববার (২১ আগস্ট) দুপুরে কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকূলের পূর্ব হামজার ডেইলের কদমতলি গ্রামে দেখা যায় এ দৃশ্য।
সাইফুলের স্ত্রী বলেন, স্বামী হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি। একে তো মা-বাবা নেই, তার ওপর ৪ বছরের এক শিশু ও গর্ভে ৫ মাসের সন্তান রয়েছে। দুইটি এনজিওর কাছ থেকে কিস্তিতে টাকা নেয়ার পাশাপাশি সুদে মানুষের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছি। এখন কোন দিকে যাব, কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।
এখন আমি সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাব, কীভাবে স্বামীর ধার-দেনা পরিশোধ করব। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে কীভাবে সংসার চালাব? স্বামী তো অঢেল টাকা রেখে যায়নি। বরং ২ লাখ টাকার বেশি ধার-দেনা রেখে গেছে।
সাইফুলের মা নাছিমা খাতুন বলেন, আমরা তো ধার-দেনা নিয়ে কষ্টে দিন পার করি। সাইফুল সাগরে গিয়ে মাছ ধরে আসলে টাকা পেতাম, সংসারটা কোন রকমে চলছিল। কিন্তু এখন কে সংসার চালাবে। ছেলের বউ, নাতী ও আমরা বৃদ্ধ দুইজন কী করব। কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। কীভাবে ধার-দেনা পরিশোধ করব বুঝতে পারছি না।
শুধু পারভিন আক্তার নন; পূর্ব হামজার ডেইলের কদমতলি গ্রামে ট্রলার ডুবিতে মারা যাওয়া ৭ জেলের সব পরিবারের প্রায় একই অবস্থায়। প্রতিটি পরিবারই ধার-দেনায় জর্জরিত। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে দিশেহারা স্বজনরা।
এদিকে মহেশখালী চ্যানেলে ট্রলার ডুবিতে নিহত আরও একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। রোববার (২১ আগস্ট) সকালে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয় জেলে আবছারের মরদেহ। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কদমতলি গ্রামে তার বাড়িতে। সেখানেও শুরু হয় কান্নার রোল।
আবছারের বোন রাশেদা বেগম বলেন, আবছারই পুরো সংসার চালাত। এখন সে ট্রলার ডুবিতে মারা গেছে, এ সংসার কে চালাবে? ছোট ছোট দুই সন্তান এখন কী করবে?
আবছারের মা হাজেরা খাতুন বলেন, আমার ছেলে পেটের জ্বালায় সাগরে মাছ শিকারে গিয়েছিল। এলাকায় কোনো কাজ নেই বলে। ছেলে তো অনেক টাকা ধার-দেনা করে গেছে। প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো। এখন পরিবার নিয়ে কী গতি হবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
ট্রলার ডুবির ঘটনায় পুরো কদমতলি গ্রামে শোকের মাতম চলছে। শনিবার ও রোববার সাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় একই গ্রামের নিখোঁজ ৭ জেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এখনও নিখোঁজ রয়েছে ১ জেলে। সাগরে নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ করছেন স্থানীয় জেলে ও কোস্টগার্ড সদস্যরা।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি শেখ মুনীর উল গিয়াস বলেন, ট্রলার ডুবির ঘটনায় শনিবার দুই জন ও রোববার সকালে ও বিকেলে ৫ জেলের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয় জেলে ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা।
এরা হলেন: নাজির হোসেনের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২৮), ছৈয়দ নুরের ছেলে নুরুল ইসলাম (৩৫), মৃত মো. সুলতানের ছেলে হোসেন আহমদ (৪২), আবুল হোসেনের ছেলে আজিজুল হক (৩২) ও নুরুল হকের ছেলে মো. আবছার (২২), মোহাম্মদ তৈয়ব ও সাইফুল ইসলাম। এ নিয়ে দুদিনে ট্রলার ডুবিতে ৭ জনের মরদেহ এবং ১১ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত খোরশেদ আলম নামে এক জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।
এদিকে নিখোঁজ জেলে খোরশেদ আলমের ফেরার অপেক্ষায় খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাঁধে অপেক্ষা করছেন তার স্বজনরা। নিখোঁজ খোরশেদ আলমের ভাই মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘ট্রলার ডুবির পর থেকে বাঁধে এসে অপেক্ষা করছি, কখন ভাই ফিরে আসবে। কিন্তু ৩ দিন পার হয়ে গেল, ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ট্রলার ও স্পিড বোট নিয়ে সাগরে খোঁজাখুঁজি করেছি। ১১ জেলে জীবিত উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু আমার ভাই খোরশেদের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।’
কোস্টগার্ড কক্সবাজার অফিস জানিয়েছে, সাগরে ট্রলার ডুবির পর থেকে উদ্ধার অভিযান চালানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৭ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। বাকি নিখোঁজ এক জেলেকে উদ্ধারে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় শুক্রবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে নাজিরারটেক চ্যানেলে ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে যায় এফবি মায়ের দোয়া নামে একটি ফিশিং ট্রলার। এ ট্রলারটি মালিক খুরুশকুল লামাজিপাড়ার মৃত. শুক্কুর আলীর ছেলে জাকের সওদাগর।