প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন দিনের সফরে আগামী ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লি যাচ্ছেন। এই সফরে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু সুরাহার সম্ভাবনা না থাকলেও সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সেপা) নিয়ে অগ্রগতি হতে পারে। সেপার আওতায় দুই দেশের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা সম্প্রসারিত হবে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার ঘোষণা প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকেও বাণিজ্য সুবিধা সম্প্রসারণে উৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের একটি রাজনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন বিতর্কিত হলেও আন্তর্জাতিক চাপকে সামাল দিতে ভারত জোরালো ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার জন্য ভারতকে অনুরোধ জানানোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের আলোচিত বক্তব্য এই সফরকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে, যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের কোনো দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
খসড়া সফরসূচি অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লি পৌঁছবেন। এদিন তিনি দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের আয়োজনে নৈশভোজে যোগ দেবেন। পরদিন সকালে রাজঘাটে গান্ধী সমাধিস্থলে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পর রাষ্ট্রপতির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এরপর হায়দরাবাদ হাউজে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রথমে একান্তে ও পরবর্তী সময়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণাপত্র দেয়া হবে। ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের কথা তুলে ধরবেন। ৮ সেপ্টেম্বর রাজস্থানে পবিত্র আজমির শরিফ জিয়ারত শেষে তিনি ঢাকা ফিরে আসবেন।
প্রধানমন্ত্রী সফরে তিস্তা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও বাংলাদেশের অগ্রাধিকারে রয়েছে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন। আর এ বিষয়ে আলোচনার জন্য আগামী ২৫ আগস্ট দিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ২৩ আগস্ট হবে জেআরসির সচিব পর্যায়ের বৈঠক। এতে মনু, ধরলা, খোয়াই, মুহুরি, গোমতী ও দুধকুমার নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা হবে। এতে কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহার নিয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চূড়ান্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে। সিলেটে পাঁচ হাজার একর জমি চাষাবাদের সুবিধার জন্য কুশিয়ারার পানি ব্যবহার করতে চায় বাংলাদেশ। এ জন্য অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহারে ভারতের অনুমতির প্রয়োজন হবে। এছাড়া গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হচ্ছে। এই অভিন্ন নদীর পানি সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের জন্য একটি যৌথ সমীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় এই সমীক্ষার বিষয়টি আসতে পারে।
মমতা কি দিল্লিতে আসবেন?
বাংলা ট্রিবিউন জানিয়েছে, শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজধানীতে এসে তার সঙ্গে দেখা করবেন কি না, তা নিয়েও এই মুহূর্তে জল্পনা তুঙ্গে। শেখ হাসিনা নিজে চাইছেন দিল্লিতে তার সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির দেখা হোক। গত মাসেই তিনি সরাসরি মমতা ব্যানার্জিকে চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছেন, আমি দিল্লিতে আসছি, আপনিও সেখানে আসুন। এই প্রস্তাবে প্রচ্ছন্ন সায় ছিল দিল্লিরও। শেখ হাসিনা এই ‘আমন্ত্রণ’ জানানোর পর কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকেও পশ্চিমবঙ্গকে বার্তা পাঠানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দিল্লিতে আসেন তা খুবই ইতিবাচক একটা সঙ্কেত দেবে।
তিস্তার মতো যেসব অমীমাংসিত বিষয় মমতা ব্যানার্জির বাধায় আটকে আছে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে সরাসরি ও খোলামেলা কথাবার্তা হোক দিল্লিও চাইছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মমতা ব্যানার্জি দিল্লি যাওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যে সিবিআই বা ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো রাজ্যে তার দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যে লাগাতার অভিযান শুরু করেছে, তাতেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পার্থ চ্যাটার্জি বা অনুব্রত মণ্ডলের মতো তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা এখন গ্রেফতার হয়ে জেলে। আর মমতা ব্যানার্জির দল এটাকে নরেন্দ্র মোদি সরকারের ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা’ বলেই দাবি করছে।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে মমতা ব্যানার্জি আদৌ সে সময় দিল্লি আসবেন কি না, সেটাও বিরাট প্রশ্ন। তিনি এই সফর যেমন ‘কনফার্ম’ করেননি, আবার একেবারে নাকচও করে দেননি।
সেপা চুক্তির সম্ভাবনা : বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুসারে ভারতের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) চুক্তি স্বাক্ষরে অগ্রগতির সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের নীতিগতভাবে এটি অনুমোদন করা হয়েছে। এই চুক্তির লক্ষ্য হলো বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।
বিএফটিআইয়ের প্রাথমিক সমীক্ষায় দাবি করা হয়, ভারতের সঙ্গে সেপা চুক্তি হলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সংক্রান্ত বাধাগুলো দূর হবে। তখন যৌথ টেস্টিং সার্ভিস, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হবে। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বর্তমান (প্রায় ১.২৮ বিলিয়ন ডলার) রফতানি আয়ের বাইরে আরো ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানি বৃদ্ধি পাবে।
সমীক্ষায় আরো বলা হয়, সেপা চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাণিজ্য বাধাগুলো দূর হয়ে গেলে পাল্টে যাবে বাংলাদেশের আমদানি চিত্রও। ভারতের বেশির ভাগ পণ্য ও সেবা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে সহনীয় বলে এবং পরিবহন খরচ কম ও সময় সাশ্রয়ের কারণে বাংলাদেশী আমদানিকারকরা একই পণ্যের জন্য দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর বদলে ভারতমুখী হবে। তখন ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ বাড়বে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান ৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি আরো ৪ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেড়ে যাবে।
চলতি বছর মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের নিয়মিত বৈঠকে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সেপা স্বাক্ষরের বিষয়ে প্রথম ঐকমত্য দেখা যায়। পরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় সবুজ সঙ্কেত মেলে। এরপরই সেপা স্বাক্ষরের বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ একযোগে কাজ শুরু করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, এর আগে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো দেশের সেপা চুক্তি সম্পাদিত না হলেও ভারত ইতোমধ্যে সাতটি দেশের সঙ্গে এ চুক্তি করেছে। ১৯৯৮ সালে ভারত শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সেপা চুক্তি করে। এরপর সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ২০০৫ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ২০০৯ সালে, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ২০১০-১১ সালে এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে ২০১৫ সালে ভারতের সেপা চুক্তি হয়।