মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট সারা দেশ। বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। সেই ছোঁয়া লেগেছে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হলগুলোতেও। ভাত-মাছ-মাংস-ডিম থেকে শুরু করে ক্যান্টিনের প্রায় প্রতিটি খাবারের দাম বেড়েছে। এতে করে চাপে পড়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যদিও সংশ্লিষ্ট হলের প্রভোস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলছেন, তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।
চলতি অর্থবছরে ঢাবিতে বরাদ্দকৃত বাজেটের পরিমাণ ৯২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা- যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৯০ কোটি টাকা বেশি। বাজেট বাড়লেও বাড়েনি হলগুলোতে খাবারের মান, উল্টো বেড়ে গেছে খাবারের দাম। হলে খাবারের দাম বাড়ায় ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়েছেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। এতে করে খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অনেকেই বাড়তি টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন, অনেককে চলতে হচ্ছে ধার-কর্য করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন বিশ্ব সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র কামরুল হাসান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সায়মা হোসেন। তাদের আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল, ঢাবি এলাকার প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে। কামরুল থাকেন জিয়া হলে ও সায়মা রোকেয়া হলে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাইরে তো খাবারের দাম বেড়েছেই, এমনকি হলের ক্যান্টিনগুলোতেও বেড়েছে খাবারের দাম। বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি থেকে বড় অঙ্কের বাজেট পাওয়ার পরেও ছাত্র-ছাত্রীদের এসব ব্যাপারে নজরদারি করেন না বলে অভিযোগ করেন তারা।
সময় সংবাদকে কামরুল বলেন, ‘আমরা টিউশনি করে পড়ালেখা ও হাতখরচ চালাই। হলে কম দামে খাবার পাওয়া যায় বলে ৫ হাজার টাকার দুটা টিউশনিতে খাবার থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সব খরচ উঠে যেত। কিন্তু খাবারের দাম বাড়ায় প্রতিদিন অতিরিক্ত ৫০-৬০ টাকা খরচ হচ্ছে কেবল তিন বেলা খাবারের পেছনেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ক্যান্টিনগুলোতে নজরদারি বাড়ানো।’
কামরুলের কথায় সায় দিয়ে সায়মা হোসেন বলেন, ‘আগে হলে মুরগির দাম ছিল ২৫ টাকা, সেটা বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। ২৬ টাকার মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩২ টাকায়। ১৫ টাকার ডিম এখন ২০ টাকা। ৬ টাকা ভাতের প্লেটের দাম বেড়ে হয়েছে ১০ টাকা। খাবারের মানের কথা না হয় বাদ দিলাম, সেটা বরাবরই খারাপ ছিল। কিন্তু খাবারের দাম এভাবে বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।’
সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি হলে খোঁজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের করা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। বিজয়-৭১ হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে ও ক্যান্টিন ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি খাবারের দাম বাড়ানো হয়েছে। হলটিতে ৪০ টাকার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়, ৩০ টাকার পাঙাশ মাছের দাম বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা ও ৩৫ টাকার খিঁচুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। হলটিতে থাকা শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের নামে কল্যাণ তহবিল থাকার পরেও এবং সরকার থেকে বড় রকমের ভর্তুকি পাওয়ার পরেও হলের খাবারের দাম বাড়িয়ে তাদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিজয়-৭১ হলের প্রভোস্ট ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির সময় সংবাদকে বলেন, ‘দেশের প্রতিটি জায়গায় খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ব্যাপারে কোনো কল্যাণ তহবিল নেই। তবে ক্যান্টিনে যে খাবারের দাম বেড়েছে এ ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি।’
কেবল বিজয়-৭১ হল না, জসীম উদ্দীন ও সূর্যসেন হলেও দেখা যায় একই চিত্র। জসীম উদ্দীন হলের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, হলের খাবারের দাম বাড়ায়, প্রতিটি শিক্ষার্থী চাপের মধ্যে আছেন।
আরও পড়ুন: ‘এক বছরের মধ্যে একাডেমিক ক্ষতি পুষিয়ে নেবে ঢাবি’
হলটির সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের কাছে দামবৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাইলে সময় সংবাদকে তিনি বলেন, ‘কী বলেন ভাই! দাম বাড়ছে নাকি! আমি তো এসবের কিছুই জানি না। আপনি ক্যান্টিন কমিটির আহ্বায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’
এ ব্যাপারে জসীম উদ্দীন হলের ক্যান্টিন কমিটির আহ্বায়ক আবু তাহেরের সঙ্গে দুদিন ধরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে বলেন, ‘হলে রেশনিংয়ের কোনো সুবিধা নেই। যদি চাল-ডাল-তেলে অন্তত রেশনিংয়ের একটা সুবিধা থাকত তাহলে দাম সামাল দেয়া যেত।’
হলের খাবারের দামবৃদ্ধি নিয়ে সূর্যসেন হলের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে ছাত্রলীগ কর্মী তানভীর আহমেদ স্বাধীন বলেন, ‘সব কিছুর দাম বাড়ছে, হলের খাবারের দামও তাই বাড়ছে। কারো কাছে টাকা না থাকলে ক্যান্টিনে তার টাকা দেয়া লাগে না। এগুলো নিয়ে কোনো চাপ নেই।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিচয়ে তারা হলগুলোতে ফ্রি খেয়ে থাকে। আমাদের কষ্ট তারা কীভাবে বুঝবে। উল্টো তাদের একাংশ হলে ফ্রি খায় বলে, ক্যান্টিন মালিকরা লোকসান সামলাতে খাবারের দাম বাড়িয়ে দেয়। এর চাপ পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপরে।’
সূর্যসেন হলে খাবারের দামবৃদ্ধি প্রসঙ্গে হলটির প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মকবুল হোসাইন বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি এখনো কিছু জানি না। জেনে জানাচ্ছি।’ পরবর্তীতে মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
হলের খাবারের দামবৃদ্ধি ও প্রভোস্টরা কেন জানেন না এ ব্যাপারে ঢাবির উপাচার্য (ভিসি) মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ব পরিস্থিতি খারাপ তাই এর প্রভাব পড়েছে সব জায়গায়। তবে এত সমস্যার মধ্যেও ঢাবি তার খাবারের মান ও দাম ঠিক রেখেছে।’
হলের খাবারগুলোর দাম বেড়েছে এবং একেক হলে একেকভাবে দাম বেড়েছে কেন জানতে চাইলে ভিসি বলেন, ‘যারা এখানে থাকে ও খায় তারা জানে দাম ঠিকাছে।’
শিক্ষার্থীদের বক্তব্য ও প্রভোস্টদের খাবারের দাম বাড়ার বিষয়টি না জানার কথা ভিসিকে জানানো হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তিনি এখন পর্যন্ত কিছুই জানেন না এবং আর কথাও বলতে চাননি।