ঈগল এক্সপ্রেসের চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় দূরপাল্লার গণপরিবহনে যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি বাসে ডাকাতি, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ বেড়েছে। এর পেছনে অন্তত হাফ-ডজন কারণ রয়েছে।
গত ৩ আগস্ট রাতে কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা ঈগল এক্সপ্রেসের বাসটি নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার পথে সংঘবদ্ধ একদল ডাকাতের কবলে পড়ে। মহাসড়কের পাশে সিরাজগঞ্জের একটি হোটেলে যাত্রীরা খাওয়া-দাওয়া করার পর যাত্রা শুরু করে বাসটি। পথে যাত্রী বেশে তিন ধাপে ১৩ জন ডাকাত ওঠে বাসটিতে। যাত্রীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চলন্ত বাসে তাণ্ডব চালায় তারা।
গলায় চুরি ঠেকিয়ে চালক, হেলপার ও সুপাইভাইজারকে বেঁধে ফেলার পর যাত্রীদেরও বেঁধে ফেলে ডাকাত দলের সদস্যরা। পরে বাসটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাত্রীদের মালামাল লুটপাট করে তারা। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এই তাণ্ডবের মধ্যেই এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরে টাঙ্গাইলের মধুপুরের রক্তিপাড়ায় একটি বালুর স্তূপে বাসটি উল্টে দিয়ে পালিয়ে যায় ডাকাত দল।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত শুক্রবার রাতে গাজীপুরে তাকওয়া পরিবহনে ডাকাতি ও স্বামীকে নামিয়ে দিয়ে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর আগে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি বগুড়া থেকে ঢাকায় আসার উদ্দেশে ছেড়ে আসা সোনার তরী পরিবহনের একটি বাসে ডাকাতি এবং দুই নারী যাত্রী ধর্ষণের শিকার হন।
গত ২০ জানুয়ারি রাতে আর কে আর পরিবহন নামে একটি বাসে উঠার কয়েক মিনিটের মাথায় গাড়িতে থাকা ডাকাতরা চিকিৎসকসহ যাত্রীদের নির্যাতনের চালায়। ২০২০ সালে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া পিরোজপুরগামী গোল্ডেন লাইনের একটি বাস ফরিদপুরের ভাঙ্গায় পৌঁছলে চালক ও সহকারীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লুটপাট চালায় একদল ডাকাত।
২০১৮ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে সাভারের আশুলিয়ার বলিভদ্র এলাকায় ধলেশ্বরী পরিবহনের ইনসাফ ইন্টারপ্রাইজ নামের একটি বাসের চালককে ছুরিকাঘাতে খুন করে ডাকাতরা। ওই ঘটনায় বাসের হেলপার ও সুপারভাইজারও গুরুতর জখম হয়।
দূরপাল্লার বাসে এমন ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমে উঠে আসছে। প্রতিটি ঘটনাই সামনে আসার পর হাইওয়ে পুলিশসহ প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাসড়কের অনেক জায়গাতেই পুলিশের চেকপোস্ট ছিল না। হাইওয়ে পুলিশের টহলও থাকে না অনেক জায়গায়। এতে বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা বাড়ছে।
টাঙ্গাইলের ঘটনার পর ৪ আগস্ট সড়কে চেকপোস্ট না থাকার বিষয়ে এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আতাউর রহমান বলছেন, মহাসড়কে চেকপোস্ট বসানো এখন বন্ধ। কী কারণে চেকপোস্ট বসানো বন্ধ রয়েছে, তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন। সড়কে ডাকাতির ঘটনা বন্ধ করতে হলে মাঝপথে কিংবা পথিমধ্যে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি কাউন্টার থেকে যাত্রী ওঠানামা করলে ডাকাতি কিংবা এমন ঘটনা কমে যাবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, হাইওয়ে পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনী থাকলেও মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল। মহাসড়কে সিসি ক্যামেরা বসানোর ক্ষেত্রেও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। এসব কারণে দূরপাল্লার বাসে রাতে ডাকাতিসহ নানা অপরাধের নিরাপদ মনে করে বিভিন্ন চক্র।
সম্প্রতি যাত্রী-চালক-সহকারীকে জিম্মি করে লুটপাটের ঘটনা বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পথে পথে যাত্রী তুলছে দূরপাল্লার বাসগুলো। কাউন্টার ছাড়া যাত্রী তোলা নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানছে না তারা। চালক-সহকারীদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকায় বাড়তি লাভের আশায় এমনটি করা হচ্ছে। সেই সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা নানা অপকর্ম করছে। এক্ষেত্রে ডিজিটাল নাম্বার প্লেট দিয়ে মনিটরিং ও গতিবিধি নজরদারি জোরদার করা দরকার।
৪ আগস্ট গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুস সাকিব খান বলেন, চেকপোস্ট বসানো আপাতত বন্ধ রয়েছে। কতদিন ধরে বন্ধ রয়েছে তার সঠিক তথ্য আমার জানা নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য না পেলে আমরা গাড়ি তল্লাশি করি না। তারপরও মাঝেমধ্যে চেকপোস্ট বসাই। চেকপোস্ট বসালে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। চেকপোস্ট না বসানোর কারণে যানজট কিছুটা কমেছে। তবে এখন মনে হচ্ছে, মানুষের ভোগান্তি হলেও চেকপোস্ট বসানো প্রয়োজন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দূরপাল্লার পরিবহন মালিকরা স্টাফ নিয়োগের ক্ষেত্রে বাছবিচার করছে না। মাঝরাতে বাসে লোক তোলা হচ্ছে, সেটি দেখছে না মালিকরা। স্টেশন থেকে গাড়ি ছাড়ার সময় ভিডিও করার নিয়ম থাকলেও সেটি করা হচ্ছে না।
মহাসড়কে প্রশাসনের নজরদারি ও তদারকি ঠিকভাবে হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, মহাসড়কে চেকপোস্ট থাকা দরকার, তা অনেক জায়গায়ই নেই। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশের থাকার কথা, কিন্তু থাকছে না। গাড়ির ভেতরে দৃশ্যমান জায়গায় নাম্বার প্লেট না থাকায় অপরাধ বাড়ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দূরপাল্লার গণপরিবহনে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিষয়ে মালিকরা সচেতন। এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সংশ্লিষ্ট সবাই আরও সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব ওসমান আলী বলেন, যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রতিটি অপরাধের ঘটনায়ই জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই আমরা। এ ব্যাপারে বাস টার্মিনালগুলোতে মাইকিং করে সতর্ক করা হয়ে থাকে। এ ধরনের ঘটনা রোধ করতে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং না থাকার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া অনেক চালক-সহকারী ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হন না, অনেকে হলেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন না।