বাবা-মা শখ করে নাম রেখেছিল রাজা। একদিন সন্তান জগদ্বিখ্যাত হবে এমন ভাবনাই ছিল হয়তো তাদের। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে এখন পাঁচ সদস্যর সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ৩২ হাজার ৮শ টাকা বেতনের চাকরিতে টানাটানি। প্রতিমাসেই বাড়ছে ঋণের বোঝা। কীভাবে এই ঋণ শোধ দেবেন, তাও জানেন না রাজা মিয়া।
রাজা মিয়ার বাসা খিলগাঁওয়ের তালতলা এলাকায়। তেজগাঁওয়ের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। কাজ বলতে মোটরসাইকেল নিয়ে তাকে ঘুরতে হয় নানা এলাকায়। এজন্য আলাদা কোনো টাকাও পান না।
করোনার ধাক্কায় প্রায় সাত মাস বেতন অর্ধেক ছিল রাজা মিয়ার। তখন ধারকর্য করেছেন অনেক। এরপর যেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু, তখনই দ্রব্যমূল্যে লাগামছাড়া। দুই ছেলের স্কুল, বাসা ভাড়া, খাবার আর অফিসে যাতায়াতে বাইকের তেলের খরচ, সব মিলিয়ে আর পারছেন না।
গতকাল দৈনিক আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা হয় রাজা মিয়ার। আক্ষেপ করে বলেন, ‘গভীর রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কান্না করি। জানি না এ জীবন কেমনে চলবে। সন্তানদের মুখে একটু পুষ্টিকর খাবারও তুলে দিতে পারি না। একজন পিতার জন্য এ যে কত বড় আর্তনাদের, ভুক্তভোগীরা ছাড়া তা কেউ বুঝবে না।’
রাজা মিয়া বলেন, গত জানুয়ারি মাসে ২০ হাজার টাকা অফিস থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে কেটে রাখে অফিস। সর্বসাকল্যে বেতন তুলতে পারি ৩০ হাজার ৮০০ টাকা।
তিনি বলেন, খিলগাঁওয়ের তালতলায় দুই রুমের একটা বাসায় থাকি। প্রতিমাসে গুনতে হয় ১৫ হাজার টাকা। গ্যাস-পানি ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বিদ্যুৎ বাবদ গুনতে হয় প্রতিমাসে ১৫০০ টাকা।
বড় ছেলে খিলগাঁওয়ের ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলে পড়ে। মাসিক বেতন দুই হাজার টাকা। দুই বিষয়ে প্রাইভেট পড়ে, সেখানে দিতে হয় ২ হাজার টাকা। আগে ছেলেকে দৈনিক ২০ টাকা হাতখরচ দিতাম। এখন আর পারি না। ১০ টাকা করে দিই। কষ্ট হয়, এত বড় ছেলে। কিন্তু কোনো শখই পূরণ করতে পারি না।
তিনি বলেন, ‘ছোট ছেলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ন্যাশনাল আইডিয়ালে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ২ হাজার টাকা বেতনের পাশাপাশি দুটি বিষয় প্রাইভেট পড়া বাবদ দিতে হয় দুই হাজার টাকা। হাতখরচ দেই দৈনিক ১০ টাকা। দুই সন্তানের পরে এক মেয়ে হয়েছে; নার্সারিতে পড়ে। প্রতিমাসে ৫০০ টাকা দিতে হয়। অফিস শেষে বাসায় ফেরার সময় মেয়ের জন্য চিপস বা অন্য কোনো খাবার নিয়ে যেতাম। কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে কিছুই নিয়ে যাই না। তিন বেলা ভাত খাওয়াই কষ্টকর, সেখানে আলাদা যত্ন নেওয়ার সুযোগ কই!’
তিনি বলেন, ‘মেয়েটা দুধ খেতে পছন্দ করে। কিনতে পারি না। দুই-তিন মাস পর পর আধালিটার দুধ কিনে নিয়ে যাই, কী যে খুশি হয়! বাড়িতে চা তৈরি করে খাওয়ার প্রচলন ছিল, এখন নেই। ধূমপান করতাম, তাও বন্ধ করে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিমাসে ২৫ কেজি চাল লাগে। ১৮০০ টাকা খরচ হয়। এরপর শাকসবজি, ডাল, আলু, তেল আরও কত কি লাগে! আগে মাসে চারদিন মুরগি এবং গরুর মাংস খেতাম। ৭০০ টাকা গরুর মাংস, এটা কীভাবে সম্ভব! এত দাম দিয়ে আমার পক্ষে কেনা সম্ভব হয় না। গত কয়েক মাস ধরে মাসে একদিন বা দুদিন মাংস খাই। বেশির ভাগ দিন ডিম। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, ডিমও হাতের নাগালে নেই। আশি, নব্বই টাকায় এক ডজন ডিম কেনা যেত। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। আগে চাল বাদে মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকায় বাকি বাজার হয়ে যেত। এখন সাত-আট হাজার টাকায়ও কুলিয়ে উঠতে পারি না।’
রাজা মিয়া বলেন, ‘ঈদ-পার্বণে পরিবারের সদস্যদের কিছু কিনে দিতে পারি না। গত এক বছরে স্ত্রীকে কেবল এক জোড়া জুতা কিনে দিয়েছি। এমনকি ঈদের সময়েও কোনো কিছু কিনে দিতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘গত আড়াই বছর ধরে কোনো আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় যাই না। দাওয়াত দিলেও এড়িয়ে যাই। যাতায়াত ভাড়া আর কোনো উপহার নিয়ে গেলে তার খরচ, এসব বহন করার সাধ্য আমার নেই।’
রাজা মিয়া বলেন, অফিসের কাজে বিভিন্ন স্থানে মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে হয়। প্রতিদিন প্রায় এক লিটার অকটেনের দরকার হয়। আগে ৮৯ টাকা ছিল, এখন তা বেড়ে ১৩৫ টাকা। কীভাবে চলব। যে কাজ করি, তা বাইক ছাড়া চলা সম্ভব হয় না।
রাজা মিয়া বলেন, মাসের শেষ দিকে একজন ব্যবসায়ী বন্ধুর থেকে ১০ হাজার টাকা ধার নেই। বেতন পেয়ে আবার শোধ করে দেই। প্রতিমাসে শোধ দিতে পারি না। দেনা কেবল বাড়ছেই। প্রায় আড়াই লাখ টাকার ঋণ।
গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর সদরে। বাবা-মা মারা গেছেন অনেক আগে। তিনি বলেন, ‘বহু বছর বাড়ি যাই না। মাঝেমধ্যেই মন টানে, কিন্তু জীবন টেকাতে হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে গ্রামের জন্য মন টানলেই কি আর যাওয়া যায়!’
আক্ষেপ ঝড়ছে রাজা মিয়ার কণ্ঠে, ‘কত দিন হয় সবাইকে নিয়ে একটু ঘুরতে যেতে পারি না। কোথাও গেলেই খরচ। অন্তত রিকশা ভাড়া তো দিতে হয়। ১০০ টাকা এদিক-সেদিক হলেও মাস শেষে হিসাব মেলে না।’