বিগত কয়েক বছরে লোডশেডিং অর্থাৎ বিদ্যুৎবিভ্রাটের অভিজ্ঞতা ভুলতে বসেছিল দেশবাসী। কিন্তু সম্প্রতি শুরু হয়েছে রুটিনমাফিক বিদ্যুৎবিভ্রাট। এতে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে: হঠাৎ করে এ সমস্যা কী করে সৃষ্টি হলো? কতদিন ধরেই-বা চলবে এমন অবস্থা? এটি কি কেবলই বাংলাদেশে হচ্ছে, নাকি সারা বিশ্ব ভুগছে এমন সমস্যায়?
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সারা বিশ্ব এখন মারাত্মক রকমের জ্বালানি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৩ সালের তেলসংকট কিংবা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দাকেও গৌণ করে দেখা হচ্ছে বর্তমান সংকটের সামনে। করোনার প্রভাব কাটতে না কাটতেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট। সংকটে জড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়রা। পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাবে বিশ্ববাজারে সৃষ্টি হয়েছে বড় রকমের বিশৃঙ্খলা। বিশেষ করে জ্বালানিখাতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সংকটে পর্যুদস্ত সারা বিশ্ব, যার হাওয়া লেগেছে বাংলাদেশেও।
কদিন আগেও রাশিয়া যখন ইউরোপের সবচেয়ে বড় পাইপলাইন নর্ডস্ট্রিম-১ ১০ দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়, জার্মানি ভেবেছিল গ্যাসের ওভাবে তাদের কলকারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। একই ধরনের অশনিসংকেত দিচ্ছে ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রিয়াসহ অন্য ইউরোপিয়ান দেশগুলো। ইউরোপের হাতে রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প নেই। এতদিন ধরে ‘গ্রিন এনার্জি’ নিয়ে যা আলোচনা ও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা আদতে কতটা অপ্রতুল, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুকে সামনে রেখে সারা বিশ্ব শিগগিরই কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। এতে বাংলাদেশ ঠিক কোন পক্ষে যাবে কিংবা কতটুকু নিরপেক্ষ থাকবে, তা এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না।
চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বার্তা সংস্থা ব্লুমবার্গ তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলছে, ২০২৬ সালের আগে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকটের কোনো সমাধান হবে না। কেননা, গত জুনে দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ তরল গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, জ্বালানি উৎপাদক কাতারসহ বিভিন্ন দেশ ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা কেবল ২০২৬ সালের পরই চুক্তির ভিত্তিতে তেল-গ্যাস বিক্রি করবে। এতে বাংলাদেশকে খুঁজতে হবে বিকল্প পথ। কেননা, বৈশ্বিক এ সংকটে ‘অ্যাসেট ন্যাশনালিজম’ (নিজেদের সম্পদ ধরে রাখা) বেড়ে গেছে বহু গুণে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুসারে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল উপাদান তেল-গ্যাস সরবরাহে বড় রকমের সংকট সৃষ্টি হয়। একদিকে সরবরাহ সংকট, অন্যদিকে নানামুখী নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববাজারে তরল গ্যাসের দাম হয় আকাশচুম্বী। এর প্রভাব পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর, যার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা।
যদিও ব্লুমবার্গ বলছে, সংকট সমাধানে লেগে যাবে কয়েক বছর, তবে ব্লুমবার্গের এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘ব্লুমবার্গ বৈশ্বিক বিবেচনায় একটা ‘প্রজেকশন’ করেছে। তারা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তুলনা করে এই পূর্বাভাস করেছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আমাদের নিজস্ব জ্বালানির সীমাবদ্ধতার মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার কাজ করছে।’
বিশ্ববাজারে জ্বালানিসংকট কতটা তীব্র?
রাশিয়ার ওপর ১০ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞার খড়গ। নিষেধাজ্ঞার পাল্টা জবাবে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার তেল-গ্যাস এবং রাশিয়া এটিকেই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাচ্ছে।
ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের সবচেয়ে বড় পাইপলাইন নর্ডস্ট্রিম-১। ইউরোপকে চাপে ফেলতে রাশিয়া পাইপলাইনটির ৮০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে ইয়ামাল পাইপলাইন থেকে গ্যাস সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে গ্যাসের অভাব সামাল দিতে পারলেও শীতকাল ইউরোপের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। গ্যাসের অভাবে বড় রকমের বিদ্যুৎ সংকটের মুখে পড়বে ইউরোপের দেশগুলো। এখন থেকে দেশের বাজারে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে জার্মানি। একইভবে ফ্রান্সও সংকট সামলা দিতে প্রাইভেট বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিতে পরিণত করছে। খবর ডয়চে ভেলে।
রাশিয়ার আরোপিত চাপ সামাল দিতে ইউরোপকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের বৃহৎ এলএনজি আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে বাড়িয়েছে গ্যাস আমদানি। চড়া মূল্যে গ্যাস কিনছে ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি সংস্থা এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্যমতে, বিগত ছয় মাসে ইউরোপে ১২ শতাংশ গ্যাস আমদানি বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিদিন দেশটি ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস আমদানি করছে।
এদিকে ইউরোপে গ্যাসের বাজার ধরতে গিয়ে আমদানি কমে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মতো দেশগুলো তাদের চাহিদামাফিক গ্যাস পাচ্ছে না। অন্যদিকে গ্যাসের জোগান বাড়াতে চাইলে দেশগুলোকে গুনতে হবে চড়া মূল্য। এতে ইউরোপের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে রিজার্ভের মায়া ছাড়তে হবে উন্নয়নশীল এসব দেশের। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ডলারের বাণিজ্যের সুবিধা না থাকায় রুশ গ্যাস পেতে চাইলে বাংলাদেশকে ভায়া হয়ে ভারতের থেকে কিনতে হচ্ছে গ্যাস, যার দামও আকাশচুম্বী। একদিকে রিজার্ভের পরিমাণ ঠিক রাখা, অন্যদিকে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রাখার জন্য লোডশেডিংয়ের আপাতত কোনো বিকল্প নেই দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর।
কতদিন চলবে এ সংকট?
ঠিক কবে নাগাদ সংকট নিরসন হবে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলোর সমঝোতার ওপর। খাদ্যসংকট সামলাতে সম্প্রতি জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় আলোচনার টেবিলে বসেছিল রাশিয়া-ইউক্রেন। গম রফতানিতে দেশ দুটি একমত হওয়ার পর বিশ্ববাজারে কমতে শুরু করেছে খাদ্যমূল্যের দাম। একইভাবে তেল-গ্যাস নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার একটি ফলপ্রসূ আলোচনায় জ্বালানি সংকটেরও বড় রকমের সমাধান আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ঠিক কবে নাগাদ এ আলোচনা হবে, আদৌ হবে কি না, এ ব্যাপারে এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জ্বালানি এজেন্সির মহাব্যবস্থাপক ফাতিহ বিরল বলেন, ‘বিশ্ব জ্বালানি সংকটের শোচনীয় রূপ দেখছে। আমি মনে করি, সামনে এ সংকট আরও বাড়বে। আমরা সংকটের চূড়ান্ত রূপ এখনও প্রত্যক্ষ করিনি। জ্বালানিসংকট সামাল দিতে দেশগুলো তাদের কার্যকলাপে বড় রকমের পরিবর্তন আনতে পারে। কেবল ইউরোপ নয়, এ সংকটে ভুগবে বিশ্বের সব কটি দেশ। এবারের শীত মৌসুম ইউরোপের জন্য হবে চ্যালেঞ্জিং। জ্বালানি সংকটে বিশ্ববাজারে দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি হবে।’
এদিকে সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানিসচিব জেনিফার গ্রানহোম বলেন, ‘আমাদের সরবরাহ চেইন আরও শক্তিশালী করতে হবে। চীনকে দেখুন, দেশটির সরবরাহ চেইনের ৮০ শতাংশ নির্ভর করে সৌরশক্তির ওপর। চীন ২০২৫ সাল নাগাদ নিজেদের সৌরশক্তির সক্ষমতা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করবে। রাশিয়ার মতো চীনও যদি বেঁকে বসে, তাহলে বিপদে পড়তে হবে আমাদের।’ খবর ব্লুমবার্গ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি বৈশ্বিক সংকটে যেখানে সবার এক হয়ে সমাধানের দিকে আসা উচিত, সেখানে দিন যত যাচ্ছে, দ্বিধাবিভক্তির পরিমাণও তত বাড়ছে। এতে জ্বালানি সংকটের আশু সমাধান আশা করা যায় না।
কোনদিকে যাবে বাংলাদেশ?
বৈশ্বিক অস্থিরতার বাতাস লেগেছে দেশের বাজারেও। বাংলাদেশ চেষ্টা করছে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাজার স্বাভাবিক রাখতে। এ ব্যাপারে জ্বালানি বিশ্লেষক লুইজা কাও বলেন, ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অনেক দেশ আগের প্রত্যাশার তুলনায় এলএনজির চাহিদা কমবে। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশ নিজেদের রিজার্ভ ঠিক রেখে ধীরগতিতে সংকট সামাল দেবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন কাও।
প্রায় একই কথা বলেছেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদে গ্যাসের জোগান নিশ্চিতের দিকে জোর দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সঙ্গে চলমান চুক্তি অনুযায়ী জ্বালানি কেনার ওপর গুরুত্বারোপ করবে সরকার।
বিদ্যুৎবিভ্রাট নিয়ে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী বর্তমান সংকটকে ‘যুদ্ধকালীন অবস্থা’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে ১০০০-১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হবে। ঘাটতি মেটাতে চলবে রুটিনমাফিক লোডশেডিং।’
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দেয়া তথ্যানুযায়ী, দেশের প্রায় ৫১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে গ্যাস থেকে, ১৮ দশমিক ৯০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল থেকে, ১৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ কয়লা থেকে, শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ জলবিদ্যুৎ থেকে, শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এবং ১০ শতাংশ আমদানি করা হয়।
করোনাকালীন ২০২০ সালে যেখানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল মাত্র দুই ডলার, ২০২১ সালের অক্টোবরে এসে একই গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ইউনিটপ্রতি ৩৫ ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের পরে হুহু করে বাড়তে শুরু করে গ্যাসের দাম। চলতি বছরের মার্চে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ৭০ ডলার। বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাস বিক্রি হচ্ছে ৪০ ডলার। সূত্র: ম্যাকেঞ্জি এনার্জি ইনসাইট।
এত দামে গ্যাস কিনে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে গেলে বাংলাদেশকে রিজার্ভ খালি করতে হবে, যা হবে অবিবেচক সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে দেশের মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে ও কলকারখানা সচল রাখতে ‘ধীরে চল’ নীতিতে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গেছে, পাকিস্তান সংকটের সম্মুখীন; সেখানে বাংলাদেশের এ নীতিকে অনেকেই দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছে।