রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু (৫৮) ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন ওরফে প্রীতি (২২) হত্যার ঘটনায় আসামি রাকিবুর রহমান ওরফে রাকিবকে জামিন দেননি হাইকোর্ট।
জামিন আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করেছেন হাইকোর্ট। এদিকে এ ঘটনায় আরও ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এনিয়ে ২২ জনকে গ্রেফতার করা হলো। ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ এ তথ্য জানান।
সোমবার (১ আগস্ট) বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী একেএম ফয়েজ। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সায়োয়ার হোসেন বাপ্পী।
এর আগে ১৬ জুন রাকিবকে গ্রেফতার করা হয়। ২৩ জুন নিম্ন আদালত তার জামিন আবেদন খারিজ করেন। এরপর তিনি হাইকোর্টে আবেদন জানান।
জামিন আবেদনকারী আইনজীবী একেএম ফয়েজ সাংকাদিকদের বলেন, টিপু ও প্রীতি হত্যা মামলায় গ্রেফতার রাকিবের জামিন আবেদন শুনানিতে জামিন না দিয়ে রুল জারির কথা বললে আমরা আবেদনটি ফিরিয়ে নিতে চাই। এরপর সেটি (নটপ্রেস রিজেক্ট) উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করেন হাইকোর্ট।
এদিকে দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমরা পারিপার্শ্বিকতা, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আগে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি কেবল তাদেরকেই ধরা হয়েছে। আমি মনে করি অন্যায়ভাবে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।’
টিপু হত্যায় জড়িত আছে এমন অভিযোগে গত ২৪ ঘণ্টায় ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছয়জনের কার কী ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন অর রশিদ বলেন, এটি একটি স্পর্শকাতর ঘটনা।
টিপু হত্যার ঘটনায় সবশেষ রোববার রাতে গ্রেফতার করা হয় সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল এবং যুবলীগ নেতা মারুফ রেজা সাগরকে, পুলিশের দাবি সোহেল এ ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড আর সাগর অস্ত্র সরবরাহকারী।
গত ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় যানজটে আটকে পড়া গাড়িতে থাকা জাহিদুল ইসলামকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হয়। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জাহিদুল। সেখানে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী প্রীতিও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
জোড়া খুনের এ দায় স্বীকার করে ৫ এপ্রিল আদালতে স্বীকারোক্তি দেন মাসুম মোহাম্মদ। মাসুমের স্বীকারোক্তির তথ্য বলছে, এ হত্যাকাণ্ডের কারণ ছয় বছর আগে মতিঝিলে খুন হওয়া যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবুর পরিবারকে আর্থিকসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেন জাহিদুল ইসলাম। ওই খুনের মামলার আসামি সুমন শিকদার মুসা। এছাড়া মতিঝিলে ঠিকাদারি ব্যবসা ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেন মুসা। এসবের বাধা হয়ে দাঁড়ান জাহিদুল ইসলাম।
মাসুম মোহাম্মদ আদালতের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে দাবি করেন, এক যুগের বেশি সময় আগে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার ঝামেলা থেকে মুক্ত করার আশ্বাস দেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু মাসুম মোল্লা শামীম। শামীমের মোবাইল ফোন দিয়ে দুদফা মুসার সঙ্গে তিনি কথা বলেন। শামীম তাকে জানান, জাহিদুলকে খুনের পরিকল্পনা হয় মতিঝিলের রূপালী ক্লাবে। এ পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছিলেন মুসা, মানিক, দামাল, শামীমসহ আরও চার থেকে পাঁচজন। মুসার নির্দেশনায় শামীম জাহিদুল হত্যা মিশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।
অস্ত্র ও মোটরসাইকেল সংগ্রহের ব্যাপারে মাসুম মোহাম্মদ দাবি করেন, জাহিদুলকে খুন করার আগের দিন সন্ধ্যায় শামীমকে সঙ্গে নিয়ে কমলাপুরের আইসিডির কাছে যান। সেখানে ৩০ বছর বয়সী কালো রঙের এক যুবকের সঙ্গে তাদের দেখা হয়। ওই যুবকের কাছ থেকে শামীম মোটরসাইকেল ও একটি ব্যাগ বুঝে নেন। পরে শামীম মোটরসাইকেল চালানো শুরু করেন। তিনি বসেন পেছনে। পরে তারা চলে আসেন মতিঝিলের এজিবি কলোনির গ্র্যান্ড সুলতান হোটেলের সামনে। তবে শামীমের মোবাইল ফোনে একটা খুদে বার্তা আসে। তাতে লেখা ছিল, জাহিদুলকে এখানে পাওয়া যাবে না। পরে আবার দুজন মিলে গোড়ান ছাপড়া মসজিদের কাছে যান। যে যুবকের কাছ থেকে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল নিয়েছিলেন, তাকে সেখানে দেখতে পান। পরে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল বুঝিয়ে দিয়ে সেদিনের মতো যে যার বাসায় চলে যান। আবার পরদিন ২৪ মার্চ দুজন কমলাপুরে ওই যুবকের কাছ থেকে মোটরসাইকেল ও অস্ত্র নিয়ে গ্র্যান্ড সুলতান হোটেলের সামনে আসেন।
টিপু ও প্রীতি হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার শুটার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মূল পরিকল্পনাকারী ও সমন্বয়কারী হিসেবে মুসার নাম আসে। পরে জানা যায়, মুসা ঘটনার আগেই ১২ মার্চ দেশ ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত চলে যান। পুলিশ সদর দপ্তর ৮ এপ্রিল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইন্টারপোলের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করে। ৮ মে জানা যায়, মুসা দুবাই থেকে ওমানে প্রবেশ করেছেন। এরপর ইন্টারপোলের ওমান পুলিশ এনসিবির সহযোগিতায় গত ১২ মে মুসাকে গ্রেফতার করে। পরে গত ৯ জুন বাংলাদেশ পুলিশের একটি টিম ওমানে গিয়ে মুসাকে দেশে ফিরিয়ে আনে। পরবর্তীতে আরও অনেক সন্দেহভাজন গ্রেফতার হয়।