হঠাৎ অনেক দিন পর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বাজারে দেখা গেল বিলুপ্তপ্রায় সুস্বাদু ‘রাণী মাছ’। গত এক মাস ধরে মাছ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন হাওর ও নদী পারের জেলেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য শ্রীমঙ্গলের নতুন বাজারে উঠাচ্ছেন দৃষ্টিনন্দন এ মাছকে।
এক সময় মাছগুলোকে বর্ষাকালে বিভিন্ন খাল-বিল ও নদী-নালাতে দেখা গেলেও বেশ কয়েক বছর ধরে আর সেভাবে দেখা যাচ্ছিল না। তবে এবার চলতি বর্ষা মৌসুমে তুলনামূলক বেশি বৃষ্টিপাতের ফলে পানির পরিমাণ বেশি হওয়াতে রাণী মাছের দেখা মিলছে।
মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, এবার মৌলভীবাজার জেলার হাওরগুলোতে পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় বিশেষ করে হাকালুকি হাওর ও কাউয়াদিঘীর হাওর এলাকায় বিলুপ্তপ্রায় সুস্বাদু ও দৃষ্টিনন্দন ‘রাণী মাছ’ অনেক ধরা পড়ছে। এছাড়া শেরপুরের কুশিয়ারা নদীতে জেলেদের ভেলজালে ধরা পড়ে এই মাছ। ওইসব নদী ও হাওর পারের জেলেদের কাছ থেকে অন্যান্য মাছের সাথে শ্রীমঙ্গলের বাজারে চড়া দামে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন তারা রাণী মাছকে।
শহরতলীর লালবাগ এলাকার বাসিন্দা ও নতুন বাজারের মৎস্য ব্যবসায়ী মো: শরিয়ত মিয়া নয়া দিগন্তকে জানান, এক সময় শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরে এ মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে হাইল হাওরের জলাশয় ও বিলগুলো মেশিন দিয়ে শুকিয়ে মাছ আহরণ করায় এগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে পরিমাণে খুব বেশি না হলেও এবার শেরপুরের কুশিয়ারা নদীতে জেলেদের ভেলজালে অন্য মাছের সাথে রাণীমাছ ধরা পড়ছে। সব সময় এই মাছ পাওয়া যায় না।
তিনি জানান, এই মাছের চাহিদা প্রচুর। রাণী মাছ বাজারে নিয়ে আসার সাথে সাথেই ক্রেতারা ভিড় করেন মাছ দেখার ও নেয়ার জন্য। দামও বেশ ভাল পাওয়া যায়। ক্রেতারা কেজি হিসেবেই রাণী মাছ ক্রয় করে থাকেন। প্রতি কেজি ৫-৬ শ’ টাকা করে বিক্রি হয়।
জানা যায়, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সঙ্ঘ (আইইউসিএন) ইতিমধ্যে এ মাছটিকে ‘বিপন্ন’ তালিকাভূক্ত করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের রক্ষিত বন্যপ্রাণীর তালিকার তফসিল ২ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
সুস্বাদু ও দৃষ্টিনন্দন এই মাছ মানুষের খাবার তালিকা ছাড়াও চাহিদা রয়েছে অন্য ক্ষেত্রে। সৌখিন মানুষরা বাসায় শোভা বর্ধনে অ্যাকুরিয়ামে রেখেও পালন করেন বউ-রানীদের। এ মাছটিকে অনেকেই বউ মাছ, বেটি মাছ, পুতুল মাছ, বেতাঙ্গী মাছসহ অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। রাণী মাছকে ইংরেজিতে বলা হয় Bengal loach বা Queen loach।
আমাদের দেশে দুই প্রজাতির রাণী মাছ রয়েছে। একটির বৈজ্ঞানিক নাম Botia dario। এ প্রজাতির রাণী মাছের দেহের রং হলুদ এবং দেহে কালচে রঙের লম্বা দাগ থাকে। অপরটির বৈজ্ঞানিক নাম Botia lohachata। এ প্রজাতির রাণী মাছের দেহও হলুদ বা হলদেটে। তবে এর দেহে ইংরেজি ‘ওয়াই’ বর্ণমালার মতো কালো দাগ থাকে এবং দু’টি দাগের মধ্যবর্তী অংশে একটি কালো দাগ অবস্থিত।
রাণী মাছের দেহ চ্যাপ্টা ও লম্বাটে। এই মাছটি প্রায় ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এই মাছ এক সময় চলনবিলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। বাংলাদেশ ছাড়াও মিঠা পানির এই মাছ ভারত, ভুটান, ও মায়ানমারের খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওর ইত্যাদির তলদেশে পরিস্কার পানিতে পাওয়া যায়। এই মাছ সাধারণত মে থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যবর্তী সময়ে প্রজনন করে থাকে। জুন-জুলাই এদের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম। একটি পরিপক্ব স্ত্রী মাছে প্রতি গ্রামে ৮-৯ শ’টি ডিম পাওয়া যায়।
অক্টোবরের শেষ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যখন বিলের পানি কমে যেতে থাকে তখন কারেন্ট জালসহ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে মাছ শিকার, মাছ ধরার ধ্বংসাত্মক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে যত্রতত্র মাছ আহরণ, মা-মাছ কিংবা ছোট-বড় মাছ বিবেচনা না করে মাছ ধরা, রাস্তা-ঘাট, বসতবাড়ি কিংবা মাছের কৃত্রিম খামার তৈরি করতে গিয়ে প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো সমূলে ধ্বংস এবং জলাশয় সম্পূর্ণ শুকিয়ে মাছ ধরার ফলে রাণী মাছসহ মিঠা পানির প্রাকৃতিক অনেক মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকরি পদক্ষেপ না নিলে অন্যন্য দেশী মাছের মতো এ মাছও অচিরেই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে বলে দাবি সচেতন মহলের।