অধ্যক্ষকে ‘পিটিয়েছেন’ এমপি, ফোনালাপ শোনালেন আ.লীগ নেতা

Slider রাজনীতি


রাজশাহী: রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) ওমর ফারুক চৌধুরী কলেজ অধ্যক্ষ মো. সেলিম রেজাকে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর এমপির পাশে বসে সংবাদ সম্মেলন করে মার খাওয়ার কথা অস্বীকার করেন ওই অধ্যক্ষ। এমপি নিজেও সংবাদ সম্মেলনে অধ্যক্ষকে মারধর করা হয়নি বলে দাবি করেন।

এদিকে, অধ্যক্ষ সেলিম রেজা নিজেই এক আওয়ামী লীগ নেতার কাছে ফোনে বর্ণনা করেছেন মার খাওয়ার কথা, যার অডিও ফাঁস হয়েছে। আজ শনিবার সংবাদ সম্মেলনে ওই অডিও রেকর্ড প্রকাশ করেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ। তবে ভুক্তভোগী অধ্যক্ষ আওয়ামী লীগের কোন নেতার সঙ্গে ফোনালাপে মারধরের ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছেন সংবাদ সম্মেলনে সে নাম প্রকাশ করেননি।

এর আগে, গত ৭ জুলাই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনা জানাজানি হলে সারা দেশে নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ১৪ জুলাই অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে নিয়ে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ওমর ফারুক চৌধুরী।

সেই সংবাদ সম্মেলনে অধ্যক্ষ সেলিম রেজা দাবি করেন, এমপি তাকে মারধর করেননি। আর গোদাগাড়ীর মাটিকাটা কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল আউয়াল রাজু দাবি করেন, এমপি নন, তিনিই এমপির সামনে সেলিম রেজাকে ধাক্কা দিয়েছিলেন। এতে আলমারিতে ধাক্কা লেগে সেলিম আহত হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে এমপি ফারুক চৌধুরী দাবি করেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তিনিই রটাচ্ছেন যে অধ্যক্ষকে মারধর করেছেন এমপি।

এমপির এই বক্তব্যের প্রতিবাদে আজ শনিবার সকালে নগরীর লক্ষ্মীপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন আসাদুজ্জামান আসাদ। তিনি বলেন, ‘এমপির হাতে মারধরের শিকার হয়ে অধ্যক্ষ সেলিম রেজা তাকে ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এ সময় তিনি এক ব্যক্তির সঙ্গে অধ্যক্ষের কথোপকথনের অডিও রেকর্ড বাজিয়ে শোনান। কার সঙ্গে এই কথা হচ্ছে- সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে চাইলে আসাদ বলেন, ‘সেটা এখন বলছি না।’

ফাঁস অডিওতে শোনা যাচ্ছে- ভুক্তভোগী অধ্যক্ষ অন্যজনকে বলছেন, ‘সেদিন এমপির অফিসে যাওয়ার জন্য অধ্যক্ষ আবদুল আউয়াল রাজু অন্য অধ্যক্ষদের ডেকেছিলেন।’ যার সঙ্গে কথোপকথন, সেই ব্যক্তি অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করেন, ‘তারপরে আপনি গেলেন?’

এর জবাবে অধ্যক্ষ বলেন, ‘হ্যাঁ গেলাম। আমি তো এমনি যাই না, ডাকলে যাই। অন্যরা সাত দিনে তিন দিনই দেখা করে। আমি আর চব্বিশনগরের প্রিন্সিপাল হাবিব ভাই না ডাকলে, কোনো মিটিং না হলে যাই না। এটাও আবার রাগ। সেদিনও আমি আর হাবিব ভাই একসঙ্গে গেছি। এই দুইটা লোক ছাড়া ভাই সবাই ওর (এমপির) পা চাটা।’

ওই ব্যক্তি এরপর প্রশ্ন করেন, ‘ওখানে যাওয়ার পরে?’ অধ্যক্ষ বলেন, ‘ওখানে যাওয়ার পরে বিড়ইলের মজিবর ছিল। ওই যে স্কুল এমপিওভুক্ত হলো। ওরা ফুল, টুল নিয়ে গেছে। ওখানে সেক্রেটারি রশিদ ভাই (গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ) ছিল। ওরা বেরিয়ে আসল। আমরা বসে ছিলাম। পাঁচ-সাত মিনিট। তারপরে রশিদ ভাইয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেক হলো। কথাবার্তা হলো ‘

অধ্যক্ষ ওই ব্যক্তিকে বলেন, ‘‘ওটা ওমর প্লাজার পূর্ব পাড়ে। তখন রাজু এসে বলছে, এই এমপি উঠে যাবে। ঢোকেন, ঢোকেন, ঢোকেন। সব ঢুকে গেলাম। ঢুকতেই প্রথম কথা। আমাকে বলছেন (এমপি)- ‘সেলিম, তোমার কলেজে কী হয়েছে?’ আমি বলছি, কই স্যার? কিছু তো হয়নি। তখনই গালি। ‘তোর অফিসে বসে আমার নামে, রাজুর পরিবার নিয়ে, আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলিস, টিচাররা কথা বলে। তুই আমাকে না বলে, ওই টিচারদের বিচার না করে’… এই উঠে এসেই মনে করেন যে কিল, ঘুষি, লাথি।’’

অধ্যক্ষ বলেন, ‘‘বারবার উঠছে-বসছে, মারছে। হকিস্টিক নিয়ে আসছে। পর্দা টেনে দিলো। প্রিন্সিপ্যালকে দিয়েই পর্দা টানাইছে। রাজু পর্দা টেনে দিলো। দিয়ে বলছে, ‘এই হকিস্টিক নিয়ে আয়। শালাকে হকিস্টিক দিয়ে মেরেই ফেলব। শালাকে আজ মেরেই ফেলব, শালা আমার বিরুদ্ধে কথা বলে। শালা বসে জস ল্যাও?’ আমি তো নিজেই জানি না কখন এটা রেকর্ড হয়েছে, কী কথা হয়েছে।’’

ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি প্রশ্ন করেন, ‘কোন টিচার রেকর্ড করেছিল, ওটার কী নাম?’ অধ্যক্ষ বলেন, ‘সিরাজুল ইসলাম। এ আবার একজনকে চাকরি দিবে বলে ৩-৪ লাখ টাকা নিয়েছিল। রাজাবাড়ির জনি। জনির কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা নিয়েছে। হাঁস-মুরগিসহ দেড় লাখ টাকার জিনিস নিয়েছে যে রাজাবাড়ি কলেজে তাকে পিয়নের চাকরি দিবে, ঢাকায় এগুলো পাঠাতে হবে।’

অধ্যক্ষ তাকে আরও বলেন, ‘‘জনি গত ১৯ তারিখে একটা দরখাস্ত দেয়- ‘স্যার, সিরাজ স্যার আমার টাকা নিয়েছে। আপনি এটার বিচার করে দেন।’ আমাকে আর সভাপতিকে। এই সিরাজকে তখন আমি বলি, এই যে জনি আপনার নামে লিখিত দিয়েছে, এটা বাইরে বাইরেই আপনি মিটআপ করে ফেলেন। তা না হলে আমি গভর্নিং বডিতে তুলব। এ ঘটনার আগেই কিন্তু ওই রেকর্ডিংগুলো করে রাজুকে দিয়ে দিয়েছে আমাকে ও টিচারদের ফাঁসানোর জন্যে।’’

অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমি ওই টিচারদের বিচার করলাম না কেন? কিন্তু আমি তো জানিই না ওটা রেকর্ড হয়েছে। এখন আমরা পাঁচজন বসলে একটা কথা হয় না? বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ নিয়ে হতে পারে। কোনো ব্যক্তি নিয়ে হতে পারে। এর মধ্যেই যদি কেউ রেকর্ডিং করে নিয়ে চলে যায়, ওখানে যে প্রধান বসে আছে, সে কি বুঝতে পারবে? এই হচ্ছে এই।’

অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘ও (সিরাজুল ইসলাম) এটা দেখে ৩০ তারিখে জনির ৮০ হাজার টাকা শোধ করেছে। ও গিয়ে আবার রাজুকে (অধ্যক্ষ রাজু) বলেছে, আপনাদের উপকারের জন্য এই রেকর্ডিংগুলো দিয়েছি। কিন্তু প্রিন্সিপ্যাল মহোদয় এ কারণে আমাকে শোকজ করেছে।’

ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি তখন বলেন, ‘তাহলে ওগুলো আলোচনা না, আলোচনা আপনাকে মারা?’ অধ্যক্ষ বলেন, ‘হ্যাঁ মারা।’ ওই ব্যক্তি জানতে চান, ‘প্রিন্সিপালদের ভূমিকা?’ সেলিম রেজা বলেন, ‘‘কোনো ভূমিকা না, আমাকে বলছে, মাফ নেন, মাফ নেন। তো আমি কিসের মাফ নিব?’ তারপরও বললাম, তো স্যার (এমপি), আমি তো জানি না, যদি আমার টিচাররা ভুল করে থাকে, আর হবে না। এই ‘যদি’ লাগিয়েছি দেখে আরও রাগ। উঠে আবার মাইর। প্রায় ১০ মিনিট।’’

অধ্যক্ষ বলেন, ‘সোহেল (দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন সোহেল) এসে আমাকে বলছে, ভাই আপনাকে নিয়ে যাই। তো আমি বলেছি যাব না। একবার গিয়ে মাইর খেলাম। যেটা হওয়ার হয়েই গেছে। ও পারলে আমার চাকরি খেয়ে লিক গ্যা। আর যদি আরও মারতে চায়, আমার বাসায় এসে মেরে যাবে। আমার কলেজে যাইয়া আমাকে মেরে চলে আসবে। ঠিক আছে? আমার চাকরি খাইয়া লিবে? খাইয়া লিক গ্যা।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিকেলে প্রিন্সিপ্যালরা এসেছিল আমার খোঁজ নিতে। তারা বলছে (এমপিকে)- স্যার, যা হওয়ার হয়েছে, আর মাইরেন না। এটা তারা নাকি যাইয়া বলেছে। আমি সকালে আবার শিবলীকে (অন্য কলেজের অধ্যক্ষ) জিজ্ঞেস করলাম। শিবলী বলছে, তার (এমপির) রাগ কমেনি। টিচারদের ওপরেও রাগ আছে। তাদেরও মারবে এ রকম। আমি বলছি, কোনো দরকার নাই। আপনারা আপনাদের মতো থাকেন। আমাকে আমার মতো থাকতে দেন। আমাকে ডাকলেও আর যাব না। তাতে ওর (এমপির) ক্ষমতা থাকলে আমার চাকরি খেয়ে লিবে।’

এই কথোপকথনের বিষয়ে জানতে ভুক্তভোগী অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে দুপুরের পর তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীকে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি।

এদিকে অধ্যক্ষকে পেটানোর ঘটনাটি গত বৃহস্পতিবার থেকেই সরেজমিনে তদন্ত করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রধান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেন বলেন, ‘বিষয়টা আমরা সিরিয়াসলি তদন্ত করছি। তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। আমরা কাজ করছি।’

এ পর্যন্ত তদন্তে কী পাওয়া যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তদন্তের স্বার্থে এখনই বলছি না। তবে এটুকু বলতে পারি, তদন্ত প্রতিবেদনে ভালো কিছুই উঠে আসবে। সঠিক বিষয়টা থাকবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *