রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বিত্তবানদের বাড়ি থেকে সারা দিন ঘুরে ঘুরে কোরবানির মাংস সংগ্রহ করেছেন তারা। নিজেদের প্রয়োজন মতো মাংস রেখে সন্ধ্যায় বাকি মাংস বিক্রি করে দেন। তাদের কাছ থেকে মাংস কেনেন ঢাকা শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষ। যাদের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। দিনশেষে তারা এসব মাংস স্বল্প দামে কিনে ঘরে ফেরেন।
প্রতি বছর কোরবানির ঈদে মাংস সংগ্রহ করে এক শ্রেণির মানুষ সন্ধ্যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কেজি দরে বিক্রি করে দেন। এই মাংস বিক্রির হাটে ক্রেতার সংখ্যা একেবারে কমও নয়। অনেক সময় দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন মাঝারি মানের হোটেল মালিকরাও স্বল্প দামে এসব মাংস কিনে নিয়ে ফ্রিজে রেখে দেন। ঈদের ছুটির পর হোটেল খুললে তার এসব মাংস রান্না করে বিক্রি করেন।
এখানে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে তাদের অনেকেই ময়মনসিংহ বা নেত্রকোনা থেকে এসেছেন মাংস সংগ্রহ করতে। আবার অনেকে রাজধানীতে থাকেন। সারা দিন মাংস সংগ্রহ করার পর নিজেদের প্রয়োজন মতো রেখে বাকি মাংস এখানে বিক্রি করছেন।
ময়মনসিংহের বাসিন্দা মো. জুলহাস করোনার বছর বাদে প্রায় প্রতিবারই কোরবানির ঈদের সময় রাজধানীতে আসেন মাংস সংগ্রহ করতে। এলাকায় তিনি দিনমজুরি করে সংসার চালান। আজ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ১৪ কেজি কোরবানির মাংস সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে চার কেজি পরিবারের জন্য রেখে বাকি ১০ কেজি ৩০০ টাকা দরে গুদারাঘাট ভাসমান কোরবানি মাংসের হাটের বিক্রি করেছেন।
তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। কোরবানির দেওয়ার সামর্থ্য নাই। তাই প্রতিবারই ঢাকায় আসি কোরবানির সময়। যা মাংস পাই এর কিছু বাড়ি নিয়ে যাই, বাকিটা বিক্রি করে দেই। এতে কিছু টাকাও আয় হয়। এটাই আমাদের ঈদের আনন্দ।
রাজধানীতে রিকশা চালিয়ে বনানী কড়াইল বস্তিতে পরিবার নিয়ে থাকেন আলাল উদ্দিন। প্রতিবার রোজার ঈদে গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় গেলেও কোরবানির ঈদে ঢাকায় থেকে যান মাংস সংগ্রহ করতে। তিনি আজ সন্ধ্যায় ভাসমান এই হাটে সংগ্রহ করা কোরবানির মাংস বিক্রি করতে এনেছেন।
আলাল উদ্দিন বলেন, আজ ১০ কেজির ওপরে কোরবানি মাংস পাইছি বনানী ও মহাখালী এলাকা থেকে। ঘরে তো ফ্রিজ নাই, এত মাংস রাখমু কই। তাই ৬-৭ কেজি মাংস বিক্রি করে দিচ্ছি। এতে আমারও কিছু লাভ হইল আর যারা আমাগো মতো কোরবানি দিতে পারে নাই কিন্তু ঢাকায় থাইকা গেছে তারাও কম দামে কোরবানি মাংস কিইনা ঘরে লইয়া যায়তে পারল। অনেক হোটেল মালিকও কম দামে মাংস কিনা নিয়া যায় এহান থেইকা, পরে হালিম বানায় এই মাংস দিয়া।
ভাসমান কোরবানির মাংসের হাটের ক্রেতারা নিম্ন মধ্যবিত্ত ও রাজধানীর খেটে খাওয়া মানুষ। যাদের পক্ষে কোরবানি তো দূরের কথা, স্বাভাবিক সময়েও উচ্চ মূল্যের কারণে গরু কিংবা খাসির মাংস কেনা সম্ভব হয় না। তাই এই ভাসমান কোরবানির মাংসের হাট থেকে স্বল্প দামে মাংস কিনে অন্তত ঈদের দিন পরিবার নিয়ে খেতে পারেন।
রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় একটি কক্ষ ভাড়া করে এক সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন সিএনজি অটোরিকশা চালক মানিক মিয়া। বাড়তি আয়ের আশায় ঈদের বাড়ি যাননি তিনি। ঈদের দিনও সিএনজি চালিয়েছেন ঢাকায়। বাসায় ফেরার সময় সন্ধ্যার দিকে গুদারাঘাটের ভাসমান কোরবানির মাংসের হাট থেকে ৬০০ টাকায় দুই কেজি গরুর মাংস কিনেছেন তিনি।
বাসার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে মানিক মিয়া বলেন, কোরবানির ঈদে ঘরে ঘরে মাংস রান্না হয়। আমার তো সামর্থ্য নাই কোরবানি দেওয়ার। তাছাড়া দামের কারণে গরুর মাংস কিনতেই পারি না। কোরবানির ঈদে ঘরে মাংস রান্না না হইলে খুব খারাপ লাগে। ঘরে বউ-পোলা আছে। তাই এখান থেইকা ২ কেজি মাংস কিনছি। এখন বাসায় নিয়ে গেলে রান্না হবে। প্রতিবার আমাগো ঈদ এমনি কাটে।
ভাসমান কোরবানির মাংসের হাটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, ঈদের দিন ও ঈদের পরের দিনও কোরবানির মাংস এসব ভাসমান হাটে বিক্রি হয়। ঈদের দ্বিতীয় দিনও অনেকে রাজধানীতে পশু কোরবানির দেন এবং গরিব-দুঃখী মানুষদের মধ্যে বিলি করেন। এসব মাংস কেজি হিসেবে বিক্রি করা হলেও তা ওজন করে বিক্রি করা হয় না। চোখের পরিমাপে এক কেজির ধারণা করে বিক্রি করা হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা করে।