ডর্টমুন্ড: সাভারের রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু আলোড়ন তুলেছিলো বিশ্বমিডিয়ায়। সারা বিশ্বের মতই ইউরোপের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোর শিরোনামেও তখন ঠাই পায় মর্মান্তিক ওই ঘটনা সহ বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের নানা দিক।
দেখতে দেখতে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও রানা প্লাজা সম্পর্কে এখনও আগ্রহ অটুট রয়েছে ইউরোপীয় মিডিয়ার।
রানা প্লাজা ধসের দু’বছর পূর্তিতে বেশ ফলাও করে সংবাদ প্রচার-প্রকাশ করেছে ইউরোপের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণ ও সংবাদমাধ্যম।
ইউরোপের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি আর বাংলাদেশের বড় বাজার হিসেবে পরিচিত জার্মানির বিভিন্ন মিডিয়া রানা প্লাজা ধসের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে ওই দুর্ঘটনার ফলোআপ সংবাদ প্রকাশ করেছে।
সেই সঙ্গে ওই দুর্ঘটনার পর সরকারের গৃহীত নানান পদক্ষেপ, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি ও পোশাকশিল্প খাতের সার্বিক চিত্রের কড়া সমালোচনা করেছে মিডিয়াগুলো।
কয়েকটি মিডিয়া এ বিষয়ে সরেজমিন সংবাদও প্রকাশ করেছে। কেবল আজই নয়, গত কয়েকদিন ধরেই এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে মিডিয়াগুলো। এর ফলে ইউরোপের ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের ভাবমূর্তির তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
সাংবাদিক রল্ফ ওভার্টরাইসের করা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘ডেয়া টাগেসস্পিগেল’। বৃহস্পতিবারের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা যথেষ্ট নয়।৬৪টি গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। শ্রমিকরা জানে না তাদের ন্যায্য অধিকার কতটুকু। ন্যূনতম মজুরিও যৎসামান্য।ওই রিপোর্টে নাজমা আক্তার ও আতিকুল ইসলাম নামের দুজন শ্রমিকনেতার বক্তব্য রয়েছে।
এআরডি রেডিওতে তিন মিনিট ২৭ সেকেন্ডের একটি প্রতিবেদন করেছেন এর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি ইয়ুর্গেন ভেবারমান।
শুক্রবারের ওই প্রতিবেদনে সোহাগ নামের একজন গার্মেন্টস মালিককে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, জার্মানির পোশাকক্রেতারা দাম আরেকটু বাড়িয়ে দিলে তা শ্রমিকদের বেতনভাতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারতো। ওই রিপোর্টে গার্মেন্টকর্মীদের উদ্ধৃত করে বলা হয়, ন্যূনতম মজুরি বাড়লেও অনেক ক্ষেত্রে নিয়মিত বেতনই পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের সাভারসহ বিভিন্ন গার্মেন্ট সরজমিনে ঘুরে এসে একাধিক রিপোর্ট করেছেন জার্মান ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ইভন কখ্। জার্মানির জনপ্রিয় রেডিও ‘হ্যাসিসছ্যার রুন্ডফুন্’ এ বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। সেখানে তিনি তুলে ধরেন বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সর্বশেষ অবস্থা। প্রায় সাড়ে তিন মিনিটের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ পায়নি। অনেক শ্রমিকই কোনো ক্ষতিপূরণ পায় নি কিংবা নিতান্তই কম পেয়েছে। এটি অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার গার্মেন্টস থাকলেও মাত্র ২ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি চেক হয়েছে। এটি এ খাতের জন্য কোনো ভালো ইঙ্গিত বহন করে না।
এ বিষয়ে সাংবাদিক ইভন কখ্ এ প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকায় গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যা মনে হলো তা হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাত এখনও পুরোপুরি সংহত হয়নি। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ন্যূনতম মজুরি বাড়লেও অনেক গার্মেন্টে এখনও আনঅফিসিয়ালি বাড়তি কাজ করতে হচ্ছে কর্মীদের। এটার জন্য তারা মজুরি পায় না। হয়তো ওভারটাইমের নামে দু’ঘণ্টার মজুরি দিয়ে বাকি দু‘ঘণ্টা মজুরি ছাড়াই খাটানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সরকার বাংলাদেশের পোশাকখাতকে আর্থিক সহায়তার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা রক্ষা করেনি। এটা অত্যন্ত লজ্জা এবং পরিতাপের বিষয়। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, এ খাতে শৃঙ্খলা বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশ সরকার কিংবা গার্মেন্ট মালিকদের একার দায়িত্ব নয়। আমদানিকারক ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে খুচরা ক্রেতা সবারই এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। আমি একজন জার্মান ক্রেতা হিসেবে এখানকার ব্র্যান্ডকে জিজ্ঞেস করবো আমি যে এত দাম দিয়ে একটা পোশাক কিনছি আমার টাকা কোথায় যাচ্ছে।
এ বিষয়ে ভ্যার্ল শহরের বাসিন্দা সাবেক শিক্ষক অ্যালিসন ব্ল্যাক বলেন, রানা প্লাজা ঘটনার পর আমার মত অনেকেই বাংলাদেশের গার্মেন্ট কর্মীদের দুরবস্থার কথা জানতে পেরেছে। আমরা অনেকেই বাংলাদেশি পোশাক বয়কট করছি, যদিও এথিক্যালি এটি উচিত নয়। কিন্তু যারা এর জন্য দায়ী তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।