ড. মাহবুব হাসান: আমরা যারা সাহিত্যের ছাত্র তারা কালোকে কালো বলি না অনেক ক্ষেত্রেই। তাকে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সাজাই। সাহিত্য দিয়ে তো আর অর্থবিষয়ক বিষয়কে ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। যায় না বলে কোনো কথা নেই, নানাভাবেই হয়তো তাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একটি সুযোগ রেখেছেন এবার বাজেটে। সেই সুযোগ কিছুটা কাটছাঁট করে এর মধ্যেই পাস হয়েছে জাতীয় সংসদে, ৩০ জুন সকালের অধিবেশনেই।
আমি লিখেছিলাম এক রচনায় যে, গাভীর বাট থেকে দুধ দোহানোর পর, সেই দুধ কী পুনরায় বাটে ঢুকানো যায়? মানে রূপকটি হচ্ছে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা আর দেশে ফেরত আনা যায় না বা যাবে না। ফেরত আনার কোনো সুযোগও নেই। টাকার ধর্ম হচ্ছে, সে যেখানে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে সেখানেই থাকে বা থাকবে। সুইস ব্যাংকগুলোতে টাকার নিরাপত্তা এবং মালিকদের নিরাপত্তা আজ পর্যন্ত অনেকটাই নিরাপদ। সে কারণেই ওই সব ব্যাংকে বিশ্বের অবৈধ মানিলন্ডাররা নিরাপদের সেই দেশে নিজেদের অবৈধভাবে অর্জিত টাকা গচ্ছিত রাখেন। বাংলাদেশের মানিলন্ডাররাও ওই তালিকায় আছেন।
বাংলাদেশের মানিলন্ডারদের প্রধান অংশই অবৈধভাবে মানে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে দেন এবং স্বস্তিতে থেকে আবারো দুর্নীতিতে সক্রিয় থাকেন। এই দুর্নীতি সুদীর্ঘকালের। পাকিস্তানিদের কাছে থেকে এই দুর্নীতির রস আহরণের পথটি আমরা লিগেসি হিসেবে পেয়েছি, কিন্তু তাকে ফলবান করে তুলেছি আমরা গত ৫০ বছরে। আমরা রাজনৈতিকভাবে এই দুর্নীতি ও প্রশাসনিকভাবে এর ফলন বাড়ানোর সব উপাদান-উপকরণ যুক্ত করেছি। আমার এই কথা শুনতে কেমন লাগছে, তাই না। তাহলে শুনুন, অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রীর একটি কথার ব্যাখ্যা দিয়েছে।
সেই ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ঢাকায় যাদের জমি ও বাড়ি আছে তারা সবাই কালো টাকার মালিক। এ কথার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- ‘জমি মূল্য বেশি দামে তো নিবন্ধন করানো যায় না। প্রতিটি মৌজার জন্য দাম ঠিক করে দেয়া আছে। এর বেশি দামে নিবন্ধন করা যাবে না। সুতরাং, কালো টাকা তো সেখানেই সৃষ্টি হচ্ছে; কে কালো টাকার বাইরে আছে?’ বলেন অর্থমন্ত্রী।
একই প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, হয়তো যে ফ্ল্যাট দুই কোটি টাকায় নিবন্ধিত হচ্ছে, সেই ফ্ল্যাটের প্রকৃত দাম হয়তো ১০ কোটি টাকা। ফলে সরকার বাড়তি নিবন্ধন মাশুল পাচ্ছে না। এখানেই কালো টাকা সৃষ্টি হচ্ছে।’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়গুলো সবাইকে বুঝতে হবে। ঢাকা শহরে যার জায়গা আছে কিংবা যে ব্যক্তি জায়গা কিনেছেন, শুধু তিনিই বলতে পারবেন, কত টাকায় নিবন্ধন হয়েছে এবং জমির প্রকৃত বাজার দাম কত। ‘সুতরাং ঢাকা শহরে যাদের জমি বা ফ্ল্যাট আছে, তারা সবাই এক অর্থে কালো টাকার মালিক। তবে এ পরিস্থিতির জন্য আমাদের বিদ্যমান সিস্টেম বা ব্যবস্থা দায়ী। ’ (ইত্তেফাক/৩০ জুন, ২২)
কালো টাকা-সংক্রান্ত যে ব্যাখ্যা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যা ঠিক যথার্থ। ব্যাখ্যার শেষে মন্ত্রণালয় যে কথা বলেছে, তা সিস্টেমের দোষ বলে চিহ্নিত করেছে। যে সিস্টেম কালো টাকা উৎপাদন করছে, সেই সিস্টেম কেন বদলানোর কথা চিন্তা করেনি মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রী বা সরকার, সেই দায়টা কার? সেটা কি যারা ম্ল্যূ কম দেখিয়ে জমির নিবন্ধন করছেন তারা, নাকি যারা সেটা প্রত্যক্ষভাবে সিস্টেম চালু রেখেছেন এবং ব্যবহার করছেন সেই ভ‚মিসংক্রান্ত সরকারি অফিসাররা, তারা? ওই অন্যায় ও অবৈধ আইনের হোতা তারা কেন দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত হন না? এর কী জবাব দেবেন অর্থমন্ত্রী? তিনি ও তার মন্ত্রণালয় দায় স্বীকার করে সিস্টেমকে দুষলেন, কিন্তু এর সমাধান কোথায়, কেমন করে করতে হবে, সে সম্পর্কে কিছুই বললেন না। তার মানে, তিনিও যে প্রচলিত সিস্টেমের প্রবাহের মধ্যে ভেসে চলেছেন, সেটাই তিনি স্বীকার করে নিলেন এবং ব্যাখ্যায় তা বলেছেন।
প্রশাসনের এ টু জেড কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানসিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, দুর্নীতিপরায়ণ। এই দেশের রাজনীতিকরাই এই দুর্নীতি উৎপাদনের দরোজা-জানালার নির্মাতা। আর তার খেসারত দিচ্ছে নিরীহ সাধারণ মানুষ, যারা দেশের মূল অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
আইন প্রণেতারা আইন প্রণয়নের সময় ভবিষ্যতে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আকাক্সক্ষার জন্য আইনি পথের দুর্নীতির দরোজাগুলো খুলে রাখার আয়োজ করে থাকেন/রাখেন, যাতে তারা সেই পথে বিত্ত আয় করতে পারেন। আজকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের যে তথ্য জানা যাচ্ছে, সুইস ব্যাংকগুলোতে যে বিপুল পরিমাণ টাকা জমানো হয়েছে, তার সবই অবৈধ পথে আয়ের অর্থ। সরকারের উচিত দুর্নীতির রন্ধ্রগুলো বন্ধ করা এবং বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরত আনা।
সরকার জানে কারা মানিলন্ডারিং করেছে এবং করছে। সরকারের রাজনীতিক ও সরকারের দায়িত্বশীল কর্তারাই ওই অবৈধ টাকার মালিক। সরকারি ব্যাংকের কর্তারা জানেন, ঋণের টাকা কারা ফেরত না দিয়ে তা পাচার করছেন। কারা আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করে বিদেশে টাকা জমিয়ে পাহাড় বানিয়েছে। সেই টাকা ফেরত আনতে হলে এক একজন করে আটক করে তাকে দিয়েই ফেরত আনতে হবে? সেটা কি সরকার পারবে?
কারণ তারা তো রাজনৈতিক সরকারের বিশ্বস্ত কর্তা, রাজনৈতিক সহযোগী, প্রতিদিনকার রাজনৈতিক কর্মের ভাগিদার। তারা তো সরকারেরই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। দয়া করে বিরোধীদের মানিলন্ডার হিসেবে চিহ্নিত না করে ক্লিনজিং কাজটি নিজ দল দিয়েই শুরু হোক। এতে তো সরকারের ক্ষতি নেই। লাভটা দেশের, দেশের মেহনতি জনগণের, যারা এ দেশের সব সম্পদের মালিক এবং রাষ্ট্রেরও মালিক। কি পারবেন তো?
অর্থমন্ত্রী স্বীকার করলেও সরকার তো তা স্বীকার করবে না। কারণ সরকারের সাথে রাজনীতিকরাই ওই অপকর্মের হোতা। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে প্রত্যেক সরকারের কিছু রাজনীতিক যেমন এটা করেন/করেছেন, তেমনি তাদেরই সহযোগী হিসেবে করেন প্রশাসনের সচিব থেকে উপরস্তরের অধিকাংশ কর্মকর্তা। সৎ কর্মকর্তা যে একেবারেই নেই প্রশাসনে, তা নয়। কিছু সৎ মানুষ থাকলেও ওই কথিত সিস্টেমের কারণে অসৎ হতে হয় তাদের। ঘুষের অর্থ না নিলেও ঘুষের চেইন অব কমান্ডের কারণে, তারাও অধিভুক্ত হন।
উদাহরণ হিসেবে কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজের পাশে বসানো যায় পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ঘুষের বিষয়টি। ট্রাফিক পুলিশ প্রকাশ্যে ঘুষ নেয়। অবৈধভাবে চাঁদা উঠায় ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক চেলা-চামুণ্ডারা। আসন্ন কোরবানির গরুর হাটে আসা গাড়িগুলো থেকেও তারা চাঁদা উঠাচ্ছে এবং উঠাবে। দেশের চার হাজার ৪০৭টি গরুর হাটের ইজারাদারি পাওয়া লোকগুলো তো সরকারদলীয় নেতাকর্মী। এটা তাদের আয় বাড়ানোর ইভেন্ট। বহুকাল ধরেই এই চাঁদাবাজি চলছে। আবার থানা পুলিশ বিনা অপরাধীদের ধরে রেখে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায় করে। টাকা না দিলে পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেরাই সাদাসিধা মানুকে অপরাধী সাজায়। এরকম বহু ঘটনাই আমরা পত্রিকায় নিত্যই পড়েছি, পড়ি। অনেকেই বলেন, দুর্নীতি কোথায় নেই? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি এমন স্তরে পৌঁছে গেছে যে, এর শাখা প্রশাখায় বিদ্যুৎ চমকের মতো ঘুষ জিলকাচ্ছে।
সরকার এটা জানেন, আমরাও জানি, জনগণও জানেন, জানেন রাজনীতিকরাও, কিন্তু এই সিস্টেমের কারণে কিছু করতে পারেন না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও এতদসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে প্রণেতারা থমকে যান। কারণ ওইভাবে যদি আইন প্রণীত হয় এবং তা আইনে পরিণত হয়, তা হলে যারা এটা প্রণয়ন করেছেন তারাসহ গোটা সামাজিক/বাণিজ্যিক/অর্থনৈতিক এবং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নই ধরা পড়বে। ফলে ওই কাজটি তারা আর করেন না, নিজেদের স্বার্থেই করেন না।
এই যে নিজেদের স্বার্থ- এটাই হচ্ছে আসল। আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজের কথা চিন্তা না করেই সিস্টেমের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। সত্যিই আমাদের প্রশাসনের যে সিস্টেম, তা কেবল দুর্নীতিকেই ফলবান করতে উৎসাহী করে না, তার প্রবৃদ্ধি যাতে জাতীয় জিডিপিকেও পেছনে ফেলে যেতে পারে, সেই কাজটিই করে। ওই প্রশাসনিক ধারাটি ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া ঔপনিবেশিক সিস্টেমজাত এবং জনগণকে শত্রু বিবেচনা করে প্রণীত। ফলে শাসক রাজনীতিক ও শাসক প্রশাসক প্রভু, শাসিতজনগণ ভৃত্যসহ। তাদের কোনো অধিকারই নেই বললেই চলে।
জনান্তিকে বলি, সাবেক একজন কাস্টমস কর্মকর্তা আমাকে একবার বলেছিলেন তারা প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ ঘুষ হিসেবে নেন, তা জাতীয় বাজেটের সমান। (উল্লেখ্য, তখন দেড় লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রণীত হতো প্রতি বছর) সত্য মিথ্যা তিনিই জানেন। তবে কাস্টমসের অফিসারদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব নিলেই তার বক্তব্যের সত্যতা মিলবে। আমি জানি সরকার এ কাজে হাত দেবে না। কারণ যাদের নিয়োগ দেবে এই যাচাই কাজে, তিনি ও তারাই ঘুষ-দুর্নীতির অংশীদার, হোতা। ফলে ওই সব প্রকল্প ব্যর্থ হতে বাধ্য।
সরকার কি সিস্টেম পাল্টাবে? মুক্তিযুদ্ধ করে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশে পরাধীনকালের আইন বা প্রশাসনিক সিস্টেম চলে কেমন করে?