জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে লিটারে ২০-৩০ টাকা

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহতভাবে বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে লিটারে ২০-৩০ টাকা তেলের দাম। এর ফলে প্রতিদিন প্রায় শতকোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি)। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে তিন মাস পর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি আমদানির সক্ষমতা হারাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন প্রেক্ষিতে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে লিটারে ২০-৩০ টাকা তেলের সরবরাহ ঠিক রাখতে দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে চায় সরকার। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও সবুজ সংকেত দিয়েছেন। তবে দাম বাড়ালে মানুষের জীবনযাত্রাসহ বিভিন্ন খাতে এর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে- গভীরভাবে তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। চলছে চুলচেড়া হিসাব-নিকাশ। জ্বালানি বৃদ্ধির ফলে গণপরিবহনে যে লাগামহীন নৈরাজ্য তৈরি হয়- কীভাবে তা নিরসন করা যায়, সরকারের ভাবনায় রয়েছে সেটাও। সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ২০ থেকে ৩০ টাকার মতো বাড়তে পারে।

এবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে পারে লিটারে ২০-৩০ টাকা তেলের দাম বাড়ানোর আগেই গণপরিবহন ও লঞ্চ ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে চায় সরকার, যাতে মালিকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো আদায় করে নৈরাজ্য তৈরি করতে না পারে। তাই লিটারে ডিজেলের দাম ২০ কিংবা ৩০ টাকা বাড়ানো হলে কিলোমিটারপ্রতি কত টাকা পরিবহন ভাড়া

বাড়বে সেই হিসাব চলছে। এ বিষয়ে পরিবহন মালিক ও তেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গতকাল সোমবার বিদ্যুৎ ভবনে বৈঠকও করেছে জ্বালানি বিভাগ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সভাপতিত্বে তাতে অংশ নেন জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. নাজমুল আহসান, অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ শের আলীসহ জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির সিনিয়র কর্মকর্তারা। ছিলেন বিআরটিএ, বিআইডব্লিটিএসহ জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পরিবহন মালিক সমিতি, পেট্রোলপাম্প মালিক সমিতি, কভার্ডভ্যান মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারও। একটি সূত্র জানায়, প্রতি লিটারে ৩০ টাকা তেলের দাম বাড়লে কিলোমিটারপ্রতি বাসের সম্ভাব্য ভাড়া হবে ২ টাকা ৩৯ পয়সা এবং দূর পাল্লার ক্ষেত্রে ২ টাকা ০৫৮ পয়সা। আর ২০ টাকা বাড়ানো হলে কিলোমিটারপ্রতি সম্ভাব্য ভাড়া হতে পারে ২ টাকা ৩১ পয়সা, দূরপাল্লার ক্ষেত্রে ১ টাকা ৯৭ পয়সা।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, পরিবহন মালিক সমিতিসহ জ্বালানি তেল ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণির নেতাদের উপস্থিতিতে নিজেদের অবস্থা তুলে ধরে বিপিসি। বলা হয়, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে প্রতিদিন একশ কোটি টাকার ওপরে সংস্থাটি লোকসান করছে। দাম যে আরও কত বাড়বে সেটা অনুমান করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায়ও জ্বালানি তেল সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে বিপিসি। তবে মূল্য সমন্বয় না করলে তা অব্যাহত রাখা কঠিন হবে। বিপিসি বলছে- আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি ব্যারেল ডিজেল যদি ৮৪ দশমিক ৬৪ মার্কিন ডলারে আমদানি করা যায়, তবে বিপিসি ব্রেক ইভেন পয়েন্টে থাকে। তখন কোনো লোকসান হয় না। একই সঙ্গে অকটেন যদি প্রতি ব্যারেল ৯০ দশমিক ৮৯ টাকায় আমদানি করা যায় তখনো ব্রেক ইভেন পয়েন্টে থাকে; কিন্তু গত ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে অব্যাহতভাবে ডিজেল ও অকটেনের দাম বাড়ছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ১ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ডিজেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১৭১ দশমিক ৮৬ মার্কিন ডলার এবং অকটেনে দাম ব্যারেলপ্রতি ১৪৮ দশমিক ৭৩ মার্কিন ডলারে বিক্রি হচ্ছে। একই সঙ্গে ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত জ¦ালানি তেলের দামও বেড়ে ব্যারেলপ্রতি দাঁড়িয়েছে ১১৫ মার্কিন ডলার। বিপিসিকে সেই বাড়তি দাম দিয়েই তেল আমদানি ও সরবরাহ করতে হচ্ছে। আর দেশের বাজারে প্রতিলিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়, এক্ষেত্রে বিপিসিকে লোকসান দিতে হচ্ছে ৫৫ টাকা ১৬ পয়সা। অকটেন বিক্রি হচ্ছে ৮৯ টাকা লিটার, লোকসান গুনতে হচ্ছে ৩৬ টাকা ৬১ পয়সা। এ ছাড়া দেশের ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) উৎপাদিত পেট্রোলেও ১০ টাকা ৮৭ পয়সা লোকসান দিচ্ছে বিপিসি। সেই পেট্রোল প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ৮৬ টাকায়। আমদানি না করলেও জ্বালানিটির উৎপাদনখরচ ৯৬ টাকা ৮৭ পয়সা।

বিপিসি তাদের হিসাববিবরণী তুলে ধরে বলছে, দেশে প্রায় প্রতিবছর ৬৮ লাখ টন জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়ে থাকে, যার পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এ তেলের মধ্যে ডিজেল ব্যবহার হয় মোট জ্বালানি তেলের ৭০ শতাংশ, অকটেন ৫ শতাংশ, পেট্রোল ৬ শতাংশ, কেরোসিনসহ অন্যান্য জ্বালানি তেল ব্যবহার হয় ১৯ শতাংশ। যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে জ্বালানি তেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, যা প্রায় ৬৫ শতাংশ। এর বেশির ভাগই ডিজেল। কৃষিতে ডিজেল ব্যবহার হয় ১৫ শতাংশ। তবে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত সেচকালীন একটু বেশি ব্যবহার হয়। এখন ডিজেল ব্যবহার বেশি হওয়ার কারণে এ জ্বালানি বেচে সবচেয়ে বেশি লোকসান করছে সংস্থাটি। এখন প্রতিদিন ডিজেল বিক্রিতে সংস্থাটির লোকসান হচ্ছে ৯১ দশমিক ৫৯ কোটি টাকা, অকটেনে ৬ দশমিক ৫১ কোটি টাকা, পেট্রোলে ২ কোটি ৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন ধরনের জ¦ালানি তেল বিক্রি করে সংস্থাটি প্রতিদিন ১০০ কোটি ১৮ লাখ টাকা লোকসান দিচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের আমদানি ও সরবরাহ অব্যাহত রাখতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি বা সমন্বয়ের কোনো বিকল্প দেখছে না জ্বালানি বিভাগ।

জ্বালানি বিভাগ বলছে, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম অনেক কম। জুনে আমাদের ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম যেখানে ৮০ টাকা, সেখানে ভারতে এখন বিক্রি হচ্ছে ১১২ দশমিক ৭০ টাকায়। বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৩৩ দশমিক ১৭ টাকা প্রতি লিটারে বেশি। পেট্রোল লিটারপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১০৬ দশমিক ০৩ রুপিতে। বাংলাদেশের তুলনায় ৪৩ টাকা বেশি। এ কারণে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো দিয়ে ভারতে জ্বালানি তেলের পাচার বেড়ে গেছে।

বৈঠকে উপস্থিত জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরের দিন থেকেই পরিবহন শ্রমিকরা ইচ্ছেমতো যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করতে থাকে। যেখানে হয়তো ২০ বা ৩০ পয়সা বাড়ার কথা সেখানে ৫ টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করা হয়। ফলে একটা অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা তৈরি হয় দেশজুড়ে। তাই এবার সরকার চায় পরিবহন মালিক থেকে শুরু করে সব শ্রেণির স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলে জ্বালানি তেল সমন্বয়ের আগে পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে, যেন তেলের দাম যখন সমন্বয় বা বাড়ানো হয় তখন পরিবহন ভাড়া ঘোষণায় যাতে কোনো ধরনের নৈরাজ্য না হয়।’ এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এবার গ্যাসের দাম বাড়লেও সিএনজি গ্যাসের দাম না বাড়ার কারণে পরিবহনে কোনো সংকট তৈরি হয়নি। এখন বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে পরিবহন ও লঞ্চ ভাড়া আগেই নির্ধারণের কাজ চলছে। শুধু পরিবহনমালিক নন, আরও স্টেকহোল্ডার যারা আছেন; সবার সঙ্গেই বৈঠক করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, যাত্রীবাহী মোটযানের ভাড়া পুনর্নিধারণের লক্ষ্যে গত বছরের ৭ নভেম্বর এ সংক্রান্ত কমিটি একটি সুপারিশ করে। সেখানে ঢাকা এবং চট্রগ্রাম মহানগরীতে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধির ফলে ৫২ সিটের গাড়ির হিসাব ধরে প্রতি কিলোমিটার যাত্রীপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয় দুই টাকা ১৫ পয়সা। সেই হিসাবের আলোকেই বিআরটিএর সঙ্গে আলোচনা করে এখন একটা সম্ভাব্য বাস ভাড়া নির্ধারণ করেছে জ্বালানি বিভাগ। সেখানে দেখানো হয়েছে- যদি লিটারপ্রতি ডিজেল ২০ টাকা বাড়ানো হয়, তবে সম্ভাব্য ভাড়া বাড়বে ১৬ পয়সা। সেক্ষেত্রে নতুন ভাড়া হতে পারে দুই টাকা ৩১ পয়সা।

আর যদি লিটারে ৩০ টাকা ডিজেলের দাম বাড়ে, তবে হতে পারে যাত্রীপ্রতি আগের ভাড়ার সঙ্গে ২৪ পয়সা বেড়ে হতে পারে দুই টাকা ৩৯ পয়সা।

একইভাবে দূরপাল্লার পরিবহনের ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে আগের ভাড়া সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৮০ পয়সা। এখন যদি লিটারে ২০ টাকা বাড়ে তবে সেটা হতে পারে এক টাকা ৯৭ পয়সা। আর যদি লিটারে ৩০ টাকা ডিজেলের দাম বাড়ে তবে যাত্রীপ্রতি আগের ভাড়ার সঙ্গে ২৪ পয়সা বেড়ে হতে পারে দুই টাকা ০৫৮ পয়সা।

লঞ্চ ভাড়ার ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে- জ্বালানি তেলের দাম যদি লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ে তবে আগের ভাড়ার সঙ্গে যাত্রীপ্রতি ১২ পয়সা, যদি ২০ টাকা বাড়ে তবে যাত্রীপ্রতি ২৪ পয়সা, যদি ৩০ টাকা বাড়ে তবে যাত্রীপ্রতি ৩৬ পয়সা বাড়তে পারে।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ পরিবহন মালিকদের প্রতি বলেছেন, পদ্মা সেতু বর্তমান সরকারের এক বিরাট সফলতা। মানুষ এই সেতুর সুফল পাবে। দেশের অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসবে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানি তেলের দাম অব্যাতহত বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশের বাজারে সমন্বয় করতে হবে। তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে পরিবহন ভাড়ায় যাতে কোনো নৈরাজ্য তৈরি না হয় সে কারণে আগেই সবার সঙ্গে বৈঠক করে পরিবহন ভাড়া নির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আরও যারা স্টেকহোল্ডার আছেন সবার সঙ্গে বৈঠক করা হবে। আবার যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাবে তখন জ্বালানি তেলের দাম দেশেও কমানো হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লার সঙ্গে কথা বললে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে পরিবহন ভাড়া কী হতে পারে- এ বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, আমি সেখানে ছিলাম। তবে পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ করবে বিআরটিএ।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন আহমেদ মজুমদার বলেন, আমি বৈঠকে বলেছি- যখন দেশের বাজারে ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা ছিল তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তলানিতে ছিল। এখন বেশি হওয়ায় বিপিসি লোকসানের হিসাব দিচ্ছে। তখন কত লাভ করেছিল সেই হিসাবও দেওয়া দরকার।

এদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েমনের সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক আমাদের সময়কে বলেন, আমি বৈঠকে বলেছি- তেলের দাম বৃদ্ধির আগে মানুষকে বিষয়টি জানাতে হবে। মানুষের মাইন্ড সেট ঠিক করতে হবে। তা না হলে হঠাৎ করে তেলের দাম বৃদ্ধি মানুষ মেনে নিতে পারবে না।

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার অ্যাসোসিয়েশনের কেএম জামান রুমেন, বাংলাদেশ পেট্রোলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. মিজানুর রহমান রতন, ট্যাংক লরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম বাবুল, মহাসচিব মিজারনুর রহমান রতনসহ বিভিন্ন সেক্টরের নেতারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *