চাহিদার বিপরীতে এবার কোরবানির পশুর সংকট নেই, বরং অতিরিক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার। খামারিরাও বলছেন, সরবরাহে ঘাটতি নেই। তার পরও এ বছর কোরবানির পশু কিনতে গুনতে হবে বাড়তি টাকা। খামারিরা জানান, বছরের ব্যবধানে পশু প্রতিপালনে খরচ অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে পশুখাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এর প্রভাব কোরবানির হাটের পশুর দামেও পড়বে। গত বছরের চেয়ে এবার বেশি দামেই পশু কিনতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
কেরানীগঞ্জের ফিট অ্যান্ড ফ্রেস এগ্রোর কর্ণধার আকবর আলম উপল জানান, গত বছর তার খামারে যে গরু এক লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার সেটি এক লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাব অনুযায়ী এবার তার খামারে কোরবানির পশুর দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আমাদের সময়কে উপল বলেন, কেবল আমার খামারেই নয়, রাজধানী ও আশপাশের খামারগুলোতে এবার দাম একই হারে বাড়তি রয়েছে। মূলত গোখাদ্যের দাম বছরের
ব্যবধানে অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। গতবার এক লাখ টাকায় সাড়ে তিন মণ ওজনের কোরবানির গরু পাওয়া গেলেও এবার সেখানে পাওয়া যাচ্ছে পৌনে তিন মণ থেকে তিন মণ ওজনের গরু।
উপল জানান, বছরের ব্যবধানে বেশিরভাগ গোখাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। গমের ভুসির বস্তা (৩৭ কেজি) আগে ১১০০-১২০০ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন তা ১৮০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু দিন আগেও ২২০০ টাকায় কিনতে হয়েছে। অপরদিকে ধানের কুড়ার কেজি এখন ১৩-১৪ টাকা কেজি কিনতে হয়, আগে যা ৮-৯ টাকা কেজি ছিল। মসুরের ভুসি এখন ৩৮-৪০ টাকা কেজি, আগে ছিল ২৫-২৬ টাকা। বুটের ভুসির কেজি ৬০-৬৫ টাকা কিনতে হচ্ছে, আগে কিনতে পেরেছি ৪০-৪২ টাকা। খাবারের দাম এই হারে বেড়ে যাওয়ায় পশুর দামও বেড়েছে।
কেবল রাজধানীর খামারগুলোতেই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পশুর খামারগুলোতেও এবার দাম অনেকখানি বাড়তি রয়েছে বলে জানা গেছে। কোরবানির হাটে তুলবেন বলে পাবনা জেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের খামারি মো. রাজু আহমেদ এবার ৪৫টি গরু লালন-পালন করেছেন। ইতোমধ্যে তার বেশিরভাগ গরু বেপারিদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দাম গতবারের চেয়ে এবার অনেকটাই বেশি বলে জানান তিনি।
রাজু বলেন, গতবার যে গরু এক লাখ টাকায় ছেড়ে দিয়েছি, এবার তা এক লাখ ৩০-এর নিচে ছাড়তে পারছি না। গরুর চেহারা ও শরীরের গঠনভেদে এক লাখ ৫০ হাজার টাকায়ও বিক্রি করছি। খাবারের দাম বাড়াতেই গরুর দাম এত বাড়তি এবার। তার ওপর এবার ট্রাক ভাড়াও বেশি। সব মিলিয়ে দাম এবার একটু চড়া থাকবে।
এদিকে সরকারের হিসাব বলছে, এ বছর কোরবানির জন্য দেশে ৯৭ লাখ পশুর চাহিদার বিপরীতে এক কোটি ২১ লাখ প্রাণী রয়েছে। অর্থাৎ ২৪ লাখ পশু অতিরিক্ত রয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গতকাল প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে কোরবানির পশুর চাহিদা নিরূপণ, সরবরাহ ও অবাধ পরিবহন নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ তথ্য জানান। সভায় মন্ত্রী বলেন, চাহিদার চেয়ে বেশি থাকায় কোনো ধরনের সংকট হবে না।
চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত পশু প্রস্তুত থাকলে স্বাভাবিকভাবে দাম কমার কথা থাকলেও বাজার বলছে ভিন্নকথা। চাহিদার অতিরিক্ত পশু থাকার পরেও এবার কোরবানির পশুর বাজার অনেকটাই চড়া রয়েছে। প্রতিবছর দাম বাড়লেও এবার গরুর দাম একটু বেশিই চড়া বলে জানিয়েছেন খামারিরা। এর পেছনে অস্বাভাবিকভাবে গোখাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও পশু প্রতিপালনের ব্যয়কেই দায়ি করছেন তারা।
খামারিদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক শাহ্ এমরান আমাদের সময়কে জানান, দেশের চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত কোরবানীযোগ্য পশু থাকলেও খামার ও পশু প্রতিপালনে ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় পশুর দাম বেড়েছে। খামারিদের খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। অনেক খামারি লোকসান দিয়েও গরু বিক্রি করছে। বন্যা, জলাবদ্ধতায় অনেক প্রান্তিক খামারি কম দামেও গরু বিক্রি করে দিচ্ছে।
ডেইরি ফারমারস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, এক বছরের ব্যবধানে খাদ্য ও খাদ্য উপাদানের দাম বেড়েছে গড়ে ৪৬ শতাংশ, যা গরু লালন-পালনের মোট খরচের ৩০ শতাংশ। খামারিরা দামের ক্ষেত্রে যদি এই ৩০ শতাংশ খরচ সমন্বয় করতে পারেন, তবে তারা লাভ করতে পারবেন।
শাহ্ এমরান বলেন, সার্বিকভাবে পশুর পেছনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় গতবছরের তুলনায় এবছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে পশু বিক্রি হবে। এবার ছোট গরু ও ছাগলের চাহিদা অনেক। ইতিমধ্যেই এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ছোট গরু ও ছাগলের দাম এবার অনেকটা চড়া রয়েছে।
এদিকে খামারিদের অনেকেই শঙ্কায় রয়েছে পশু বিক্রি নিয়ে। চড়া বাজারে ক্রেতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। প্রসঙ্গত, গত বছরের কোরবানির সংখ্যা ছিল গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই চিড়েচ্যাপ্টা সবাই। এমন পরিস্থিতিতে সবার পকেটেই টান পড়েছে। ফলে কোরবানির পশুর পেছনে খরচ কমাবেন অনেকেই। এতে কোরবানির সংখ্যার পাশাপাশি পশু বিক্রিও কম হাওর আশঙ্কা করছেন খামারিরা।
কোরবানির হাটে বিক্রি করবেন বলে ২৬টি গরু পেলেপুশে বড় করলেও সেগুলোর বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গার খামারি শেখ আব্দুল হক আজাদ। নাগদহ ইউনিয়নের জোড়াগাছা গ্রামের এ প্রবীণ খামারি আমাদের সময়কে বলেন, আগে বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৫৫০ টাকায় পাওয়া গেছে। এখন ৭০০ টাকা। খরচ যে হারে বেড়েছে, তাতে এইবার গরুর দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই। কিন্তু দুশ্চিন্তা হচ্ছে- মানুষের পকেটে এমনিতেই টাকা নেই। এর মধ্যে বাড়তি দামে গরু বিক্রি হবে তো? বিক্রি তো করতেই হবে। কিন্তু ন্যায্য দাম পাব তো?