সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনায় বন্যার পানি কিছুটা কমলেও দুর্ভোগে অচল জনজীবন। বন্যার পানিতে ডুবে ও বিদ্যুতের ছেঁড়া তারে স্পৃষ্ট হয়ে এখন পর্যন্ত সিলেট বিভাগে ২২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। নেত্রকোনায় বন্যার পানিতে পড়ে যাওয়া সন্তানকে বাঁচাতে মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বন্যার পানিতে ভেসে আসা অজ্ঞাত এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যয়ের কারণে নিখোঁজ ও লাশ উদ্ধারের অনেক খবরই প্রশাসন জানতে পারছে না বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তাই মৃত ও নিখোঁজের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের ছাতারখাই হাওর থেকে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া মা ও ছেলের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা হলেন ওই ইউনিয়নের মহালীখাল গ্রামের নজমুন নেছা (৫০) ও তার ছেলে রহমান মিয়া (১৪)। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, শনিবার বিকালে ছেলেকে নিয়ে তিনি আমিরাবাদ গ্রাম থেকে ফিরছিলেন। এরপর বানের পানিতে তলিয়ে যান। লাশ দুটি উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর।
সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা থেকে সিদ্দিক আহমেদ (৯) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়। সে বাঘা ইউনিয়নের গন্ডামারা গ্রামের হাবিব মিয়ার ছেলে। কানাইঘাটের সাতবাক ইউনিয়নের ঠাকুরেরমাটি এলাকায় মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ওসি মো. তাজুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার মাছ ধরতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। পরদিন স্থানীয় হাওর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
শুক্রবার পানিতে পড়ে নিখোঁজ হন সিলেট সদর উপজেলার নলকট গ্রামের কলেজছাত্র আবদুল হাদি। ওইদিনই তার লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন ওই এলাকা থেকে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও স্থানীয় একটি কলেজের প্রভাষক সেলিম আহমদ জানিয়েছেন, নৌকাডুবিতে উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের সুজাতপুর গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা এ কে আবুল কাশেম ও তার দাদি ছুরেতুন নেছা মারা গেছেন।
বন্যার পানিতে ডুবে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ছৈলা-আফজালাবাদ ইউনিয়নের রাধানগরের যুবক জুনেদের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ছাতকের ইউএনও মামুনুর রশীদ। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ছাতক পৌরসভার কানাখালী রোডের আখড়া এলাকায় পীযূষ ও জাউয়া বাজার এলাকায় হানিফা বেগম নামে এক স্কুলছাত্রী পানিতে ডুবে মারা গেছে। মৌলভীবাজারের বড়লেখা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের আদিত্যের মহাল এলাকায় ঢলের পানিতে তলিয়ে এক শিশু মারা যাওয়ার খবরও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে বড়লেখা উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের আয়েশাবাদ চা বাগানে টিলা ধসে রাজ ব্যানার্জি নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
বন্যার পানিতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে সিলেট মহানগরের খরাদিপাড়ায় নিজ বাসায় মারা গেছেন মহানগর যুবলীগ নেতা টিটু চৌধুরী। জালালাবাদ থানার নোয়াপাড়ার নিজ বাসায় বন্যার পানির সঙ্গে আসা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান মনির হোসেন নামে এক যুবক।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার জুরাইল হাওরে ঘুরতে গিয়ে পানিতে পড়ে যাওয়া সন্তানকে বাঁচাতে ঝাঁপ দিয়ে জুলেখা বেগম (৩২) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের জুড়াইল গ্রামের হারেছ মিয়ার স্ত্রী। এ ছাড়া ঢলের পানিতে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ ভেসে এসেছে।
কেন্দুয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মীর মাহবুবুর রহমান জানান, গতকাল বন্যার পানিতে বেড়ানোর জন্য জুলেখা বেগম ও নাজমুন্নাহার সন্তানদের নিয়ে ডিঙিযোগে জুড়াইল হাওরে যান। এ সময় জুলেখা বেগমের কন্যা তানজিনা (৭) ডিঙিনৌকা থেকে পানিতে পড়ে গিয়ে ডুবে যায়। সন্তানকে বাঁচাতে তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়েন। সন্তান উদ্ধার হলেও জুলেখা ডুবে যান। তার লাশ স্বজনরা বাড়ি নিয়ে আসেন।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় বন্যাদুর্গতদের জন্য হেলিকপ্টারে করে দেওয়া ত্রাণসামগ্রী নেওয়ার সময় হুড়োহুড়িতে আহত এক ব্যক্তি মারা গেছেন। গতকাল সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিপ্লব মিয়া (৪৫) নামে এই ব্যক্তি মারা যান। তিনি তাহিরপুর উপজেলা সদরের উজান তাহিরপুর গ্রামের শহীদ আলীর ছেলে।
উজান তাহিরপুর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মতিউর রহমান মতি বলেন, সোমবার দুপুরে তাহিরপুরের স্টেডিয়ামে হেলিকপ্টার থেকে বন্যার্তদের ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছিল। ত্রাণ নিতে হুড়োহুড়িতে বিপ্লব মিয়াসহ ছয়জন গুরুতর আহত হন। হাসপাতালের চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিপ্লব মারা যান।
সিলেটে কুশিয়ারা তীরবর্তী ছয় উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। দুটিতে রয়েছে অপরিবর্তিত। সুরমা, ধলাই, পিয়াইন, লোভা ও সারি নদী তীরবর্তী পাঁচ উপজেলায় বন্যার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জেলায় এখনো অসংখ্য মানুষ পানিবন্দি। সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও বিজিবির উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। জেলার অনেক দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছেনি। যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দুর্গম এলাকার দুর্গত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
গতকাল সিলেটের যেসব উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে- বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার। আগের দিন থেকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে সিলেট সদর, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে। আর পরিস্থিতি অপরবর্তিত রয়েছে জকিগঞ্জ ও বিশ্বনাথের।
কুশিয়ারা নদীর পানি গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় সব পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারায় পানি বৃদ্ধির ফলে বিয়ানীবাজার উপজেলার কুড়ারবাজার, মুড়িয়া, লাউতা, শেওলা, মাথিউরা, মোল্লাপুর ইউনিয়ন ও পৌরসভার নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি লাখো মানুষ। উপজেলা প্রশাসনের হিসাবমতে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২৩ হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত সরকারিভাবে সাড়ে ৩০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বালাগঞ্জ উপজেলায়ও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উপজেলার প্রায় ৮০ ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। কুশিয়ারার পানি বৃদ্ধির ফলে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় বন্যাক্রান্ত এলাকায় অন্তত ৬ ইঞ্চি পানি বেড়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জের ইলাশপুরে সিলেট-মৌলভীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়ক তলিয়ে গেছে। উপজেলার অন্তত ৬০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি। ওসমানীনগর উপজেলার কুশিয়ারা তীরবর্তী সাদিপুর, গোয়ালাবাজার ও পৈলনপুর ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। উপজেলার বাকি এলাকাগুলোর পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। গোলাপগঞ্জের কুশিয়ারা তীরবর্তী ছয় ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ও সুরমা তীরবর্তী তিন ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ধীরগতিতে উন্নতি হচ্ছে। একইভাবে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সুরমা তীরবর্তী কুচাই, বরইকান্দি ও মোল্লারগাঁও ইউনিয়নে উন্নতি হলেও ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে কুশিয়ারার পানি ঢুকে মোগলাবাজার, দাউদপুর, জালালপুর ও সিলাম ইউনিয়নে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সিলেট সদর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ধীরগতিতে পানি নামছে। জকিগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরবর্তিত রয়েছে। বন্যাক্রান্ত উপজেলাগুলোয় তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাট ও হাটবাজার তলিয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। দ্বিগুণ হয়ে গেছে খাদ্যসামগ্রীর দাম। উপদ্রুত দুর্গম এলাকাগুলোয় টাকা দিয়েও খাদ্যসামগ্রী মিলছে না।
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। প্লাবিত এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে পানি। জেলার প্রধান নদী সুরমা এখনো বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিচু এলাকার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি এখনো নিমজ্জিত। সেখানে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সামগ্রী। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েকদিন লাগবে।
স্থানীয়রা জানান, পাঁচ দিন পর সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছে যান চলাচল। তবে জেলার অভ্যন্তরীণ অনেক সড়ক এখনো নিমজ্জিত থাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। বন্যার্তদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ত্রাণের চাহিদা। ত্রাণের নৌকা দেখলেই ছুটে আসছে শত শত মানুষ।
দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবারের ব্যাপক চাহিদা দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, জেলায় বন্যাদুর্গতদের জন্য ৬৭০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া দুর্গতদের মধ্যে ১২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। জেলায় ৬ শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন দুর্গতরা। কেন্দ্রগুলোয় রান্না করা খাবার বিতরণ করছে প্রশাসন।
রংপুরে খোলা আকাশের নিচে মানুষ : উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতে তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে কিছু এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। নদীর বাঁধসহ উঁচু স্থানে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে মানুষ।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানিসমতল বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করতে পারে। এ সময় রংপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘটের পানি বিপৎসীমার ওপরে, পানিবন্দি ৬০ হাজার : গাইবান্ধায় পানিবন্দি ৬০ হাজার মানুষ। জেলার ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ডুবতে শুরু করেছে গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নদবেষ্টিত ১৬৫ চরের নিম্নাঞ্চলসহ নদের তীরের ফসলি জমি ও বসতবাড়ি। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। গবাদি পশুর খাওয়া ও রাখা নিয়েও সংকট চরমে পৌঁছেছে। খোলা হয়েছে ১৮টি আশ্রয় কেন্দ্র। ইতোমধ্যে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ২ হাজার মানুষ।
লালমনিরহাটে ৫ শতাধিক বসতবাড়ি বিলীন : ভারী বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে লালমনিরহাটে ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাঁচ দিন ধরে পানিবন্দি থাকা এসব মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে বহুগুণ। এদিকে পানির তীব্র স্রোতে গত তিন দিনে তিস্তা-ধরলা অববাহিকায় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি। পরিবারগুলো বিভিন্ন বাঁধে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে।
টাঙ্গাইলে তিন নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে : টাঙ্গাইলে তিন নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। ৩ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, পানি বাড়ছে। প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চল। কিছু এলাকায় নদী ভাঙনও দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত : কুড়িগ্রামের সবকটি নদীর পানি সামান্য কমে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলার ৯ উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নের ২৮৪টি গ্রামের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে কষ্টে রয়েছেন। দুর্গত এলাকায় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি : গতকাল বিকালে যমুনার পানি বেড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বাড়ায় জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও বকশীগঞ্জ উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের ৫৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা দুর্গতরা বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু সড়ক, বাঁধ, রেলওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নিচ্ছেন। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট। সংকট দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যেরও।
সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৫০ সে.মি. ওপরে : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার কারণে সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার প্রায় ২২টি ইউনিয়নসহ সিরাজগঞ্জ পৌরসভার কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। অনেকে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েছে। গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
রাজবাড়ীতে বাড়ছে পদ্মার পানি : রাজবাড়ীতে পদ্মা নদীর পানি বাড়ছেই। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। পাংশা উপজেলার সেনগ্রাম পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার, সদর উপজেলার মহেন্দ্রপুর পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার। বালিয়াকান্দি উপজেলার গড়াই নদীর কামারখালী পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
কুমিল্লার গোমতী চরের ৫০৯ পরিবার পানিবন্দি : কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার গোমতী নদীর চরের ৫০৯ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের রঘুরামপুর, গঙ্গানগর ও পৌরসভার বড় আলমপুর এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এরই মধ্যে এসব এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে খোলা হয়েছে ২৬ আশ্রয় কেন্দ্র : গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওরবেষ্টিত নাসিরনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে ২৬টি আশ্রয় কেন্দ্র। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে এরই মধ্যে ৬৯টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোনাব্বর হোসেন।
ফেনীবাসীর দাবি ত্রাণ চাই না, টেকসই বাঁধ চাই : ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। এই বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এই বন্যার পানি সাধারণত ১-২ দিন থাকে। তবে পানির স্রোত বেশি থাকায় ১-২ দিনেই ধ্বংস করে দেয় সবকিছু।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে এই এলাকায় নদী রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন স্থান ভেঙে লোকালয়ে প্রচণ্ড বেগে পানি প্রবেশ করায় তাদের কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়। প্রতি বছর তারা টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য দাবি করে এলেও কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয় না। পানি উন্নয়ন বোর্ড বর্ষা শেষে যেনতেনভাবে বাঁধ মেরামত করে দেয়। যার কারণে প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে মুহুরী, কহুয়া ও ছিলোনিয়া নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। তারা আরও জানান, নদী রক্ষার বাঁধ ভাঙলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের লাভ। কারণ প্রতি বছর তারা বাঁধ নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে পারেন। এতে স্থানীয়দের যে কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে তার চিন্তা কেউ করেন না। এলাকাবাসী জানান, তারা কখনো ত্রাণ চান না। তারা চান টেকসই বাঁধ। চান স্থায়ী সমাধান।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, নদীর পানিতে তীব্র স্রোত রয়েছে। অতি জরুরি ভিত্তিতে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধগুলো মেরামত করা হবে।
উজান ভাটি দুই দিক থেকেই চাপে হবিগঞ্জ : উজান-ভাটি দুই দিক থেকেই চাপে পড়েছে হবিগঞ্জ। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যার পানি কালনি-কুশিয়ারা দিয়ে নামছে হবিগঞ্জে। অন্যদিকে জেলার ভাটি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদীর পানি বেড়েই চলছে। এতে উজান-ভাটি দুই দিক থেকেই হবিগঞ্জে ঢুকছে পানি। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত আড়াই শ গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ। বন্যা দুর্গতদের জন্য জেলায় ৯৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ৭ হাজার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের ১৯১ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ : বন্যার কারণে কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত ১৯১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার বেশির ভাগ রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। পানি উঠেছে বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এখন পর্যন্ত যে ১৫৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে তার মধ্যে ৫১টি আশ্রয় কেন্দ্র চালু করা হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মালামাল এবং গবাদিপশুও রয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বণিক জানান, কিশোরগঞ্জ জেলায় মোট ১ হাজার ৩০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বন্যার কারণে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী, তাড়াইল ও করিমগঞ্জ উপজেলার ১৯১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে শিক্ষকদের স্ব স্ব বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হবে বলে জানান তিনি।