ক্যাম্পে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ‘বাড়ি চলো’ স্লোগান

Slider সারাবিশ্ব


‘বাড়ি চলো’ স্লোগানে বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মিছিল করেছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ শিবিরগুলোর হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু।

আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবসের এক দিন আগে রোববার (১৯ জুন) সকালে ঘণ্টাব্যাপী ২৯টি ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা একযোগে ৭ দফা দাবিতে এ কর্মসূচি পালন করেন।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালীস্থ ৮ নম্বর ডব্লিউ ক্যাম্পের ব্লক এইচ-৫৪ বসবাসকারী স্বামীহারা রাবেয়া খাতুন সকাল সাড়ে ১০টায় বলেন, আমরা এখানে ভালো আছি। বাংলাদেশের প্রতি, এদেশের মানুষের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই। তারপরও নিজের দেশ, নিজের মাটি, নিজের ভিটেমাটির জন্য বেশি প্রাণ কাঁদে। তাই দ্রুত ফিরে যেতে চাই নিজ জন্মভূমিতে।

তিনি যখন কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলছিলেন তখন তার পাশে বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় চলে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ। সমাবেশে মিয়ানমারের জাতীয় পতাকা আর বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ফেস্টুন-ব্যানার নিয়ে যোগ দিচ্ছিল বিভিন্ন বয়সি রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভাষায় ও ইংরেজিতে ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে এসব কর্মসূচিতে যোগ দেয়। সেখানে লেখা ছিল- ‘আর কত দিন ..? চল চলো বাড়ি যাই, চলো মায়ানমারে যাই’, ‘মায়ানমার আমাদের মাতৃভূমি, অনুগ্রহ করে জাতিসংঘ, আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে সাহায্য করুন’, ‘বিশ্ব সম্প্রদায় দয়া করে, মিয়ানমারে আমাদের অধিকার বাঁচাতে সাহায্য করুন’ ইত্যাদি।

প্রতিটি ক্যাম্পে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা খণ্ড খণ্ড জমায়েত হয়ে এ সমাবেশ করে। এসব ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার আশফাকুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গাদের ‘গো হোম’ বা ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচি উপলক্ষ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয়েছে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের জামতলী, বৃহত্তর কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া, মধুরছড়া ও বালুরমাঠ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ওইসব সমাবেশের প্রতিটিতে কয়েক হাজার করে রোহিঙ্গার সমাবেশ ঘটে।

এ ছাড়াও উখিয়ার সবকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশাপাশি টেকনাফের দুই ক্যাম্পে এ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

‘গো হোম’ বা ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচিকে সফল করতে গত এক সপ্তাহ ধরে ক্যাম্পের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, অলিগলি ও ঘরে ঘরে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে প্রচারণা চালায় রোহিঙ্গারা। প্রচারণা কর্মসূচির দেখভাল করেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় থাকা মাঝিরা। সমাবেশে শিক্ষিত রোহিঙ্গা তরুণ-যুবকদের বেশি তৎপর দেখা গেছে।

তাদের প্রচারণার বিষয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দিতে সকালে উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে আয়োজিত সমাবেশগুলোতে সাত দফা সম্বলিত প্রচারপত্র বিলি করা হয়।

রোহিঙ্গারা ‘নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’ এর ব্যানারে এই প্রচারণা কর্মসূচি শুরু করলে ও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। ওই কর্মসূচির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জড়িত রয়েছেন দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ এর নেতৃত্বাধীন সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস(এআরএসপিএইচআর) এর সমর্থক-কর্মীরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচির ব্যানার-পোস্টার ক্যাম্পগুলোর অলিগলিতে শোভা পাচ্ছে। অনেক ব্যানারে পাঁচ বছর আগে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে দল বেঁধে বাংলাদেশ পালিয়ে আসার মুহূর্তে তোলা রোহিঙ্গাদের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ছবির ওপরে-নিচে ইংরেজি, বার্মিজ ও রোহিঙ্গা ভাষায় লেখা হয়েছে স্লোগান। একটি ব্যানারে লেখা হয়েছে, ‘আমরা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের (বর্তমান রাখাইন রাজ্য) রোহিঙ্গা জাতি। অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের আশ্রয়ে আছি। সে থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার। ফেরত নিয়ে যাওয়ার আইনি সরকারও নেই মিয়ানমারে। সুতরাং আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। চলো বাড়ি ফিরে যাই।’

রোববার সকাল সাড়ে ১০ টায় বালুখালীস্থ ১৮ নম্বর ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ের সামনের সড়কে অবস্থিত শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বক্তব্য দেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকের মাঝি শাহাবুদ্দীন, নুরুল আমিন, মাস্টার মোহাম্মদ আয়াজ ও মৌলভী ইউসুফ। তারা বার্মিজ, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য দেন।

রোহিঙ্গাদের ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা কর্মসূচিতে বাধা দেয়নি ক্যাম্প প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে সমাবেশস্থলগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ও তৎপর ছিল।

গত ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনবিরোধী মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কমান্ডার মাস্টার আবদুর রহিমের নেতৃত্বে একদল বন্দুকধারীর গুলিতে খুন হন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ। মুহিবুল্লাহ হত্যার পর এ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অনেকেই আত্মরক্ষার্থে আত্মগোপন করেন ক্যাম্প থেকে। তাই কৌশলগত কারণে মুহিবুল্লাহ সমর্থকেরা ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা কর্মসূচি ‘নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’ ব্যানারে আয়োজন করেছে। এমনটি জানালেন অনেক রোহিঙ্গা।

বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পের বি ব্লকের এম-১৯ এর মাঝি রশিদুল হক (৫৮) সমাবেশস্থলে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সোচ্চার ছিল সাধারণ রোহিঙ্গারা। সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাশার সঙ্গে মুহিবুল্লাহ সহমত পোষণ করেছিলেন।

তিনি খুন হওয়ার ছয় মাস আগে ঘোষণা করেছিলেন ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা কর্মসূচির। তার অনুপস্থিতিতে আমরা সাধারণ রোহিঙ্গারা এখন ওই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছি। আমাদের কর্মসূচি হবে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ।

আয়োজকদের একজন ই ব্লকের এম-৫ এর মাঝি জাহিদ হোসেন বলেন, কাল সোমবার ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। দিবসটিকে সামনে রেখে রোববার উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় সব কয়টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একসঙ্গে পৃথক স্থানে আমরা রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মানববন্ধনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে চাই, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। আরাকান রাজ্য (বর্তমান রাখাইন রাজ্য) আমাদের জন্মভূমি। আমরা জন্মভূমিতে ফিরতে চাই।’

রোববারের সমাবেশস্থলে ‘প্রিয় বিশ্ব সম্প্রদায়, জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি’ শিরোনামের যে প্রচারপত্রটি বিলি করা হয়েছে সেখানে উল্লেখিত সাত দফা দাবিগুলো হলো- অতি দ্রুত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা,মিয়ানমার সরকারের ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইন বাতিল, অতিসত্বর বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের তাদের মিয়ানমারের নিজগ্রামে যথাযথভাবে পুনর্বাসন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য সময় দ্রুত নির্ধারণ করা, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আইডিপি ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজগ্রামে পুনর্বাসন করা ও মিয়ানমারের সাধারণ নিরীহ জনগণের ওপর মিয়ানমারের নির্যাতন বন্ধ করা।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা তাদের জন্মভূমিতে ফিরতে চান, তাদের অধিকারের কথা জানাতে চান বিশ্ববাসীকে। সেটি জানানোর জন্য রোহিঙ্গারা জড়ো হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আমরা বাধা দিইনি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার আশফাকুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করার জন্য পূর্ব থেকেই পুলিশের অনুমতি নিয়েছে। তারা আজকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করেছে।

সমাবেশস্থলগুলোতে পুলিশের কড়া নজরদারি ছিল। রোববারের সমাবেশ যাতে কেউ বানচাল করতে না পারে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে সে লক্ষে শনিবার রাতে ক্যাম্পে পুলিশ ব্যাপক সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে।

আরআরআরসি কার্যালয়ের সবশেষ তথ্য মতে বর্তমানে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৮ লাখ ৯০ হাজার মত রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তবে বাংলাদেশে বসবাসরত মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *