স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছেন সুনামগঞ্জবাসী। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভপুর হাজার হাজার বসত ঘরে বানের পানি ডুকে পড়েছে। ছাতক ও সুনামগঞ্জ শহরের শতশত বসত ঘরের নিচতলায় কোমর পানিতে ডুবে আছে। বানভাসি মানুষ জানমাল রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পুরো সুনামগঞ্জ শহরের ৯০ ভাগ বসত ঘরে বানের পানি ডুকে পড়েছে। ছাতক শহরের শতভাগ এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। সুনামগঞ্জ ও ছাতক পৌর এলাকার প্রধান সড়কে হাঁটু পানি থেকে কোমর পানিতে ডুবে আছে।। শহরের প্রধান সড়ক গুলোতে অনায়াসে নৌকা চলাচল করছে। ৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সিলেট সুনামগঞ্জ সড়কে ৫ স্থানে কোমর পানিতে ডুবে থাকায় সুনামগঞ্জের সংগে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে।
জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ছাতক,তাহিরপুর দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভপুর উপজেলা। এসব এলাকার প্রধান সড়কে এখন সাতার পানিতে নিমজ্জিত। নৌকা ছাড়া এসব উপজেলায় যাওয়ার বিকল্প কোন বাহন নেই। সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া,সাহেব বাড়িরঘাট, উকিলপাড়া, নুতনপাড়া,শান্তিবাগ হাছননগর, পাঠানবাড়ি জেলরোড, মধ্যবাজার,পশ্চিমবাজার, বড়পাড়া, আরপিনগর,মল্লিকপুর ওয়েজখালী, হাজীপাড়া, নবীনগর সহ ৯ টি ওয়ার্ডের পাঁচশতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বানের পানি ডুকে পড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী।
বন্যায় সুনামগঞ্জ- সিলেট সড়কের গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকা প্লাবিত হয়ে সারাদেশের সাথে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে । বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জনাব মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। বন্যার কারণে সুনামগঞ্জ শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বসতবাড়ির শতশত কারেন্টের মিটার পানিতে ডুবে গেছে।
সুনামগঞ্জ ও ছাতক শহরজুড়ে এখন থইথই পানি। শহরের এমন কোনো এলাকা ও সড়ক নেই যেখানে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়নি। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের আলফাত স্কয়ার থেকে শুরু করে নবীনগর পর্যন্ত পানি আর পানি। কোথাও হাঁটু, কোথাও এর চেয়ে বেশি পানি। কাজীর পয়েন্ট এলাকায় পানি বেশি থাকায় সেখানে নৌকার যাতায়াত করেছেন লোকজন।
দোয়ারাবাজারের ইউএনও ফারজানা প্রিয়াংকা জানান , দোয়ারাবাজার পুরোটাই বন্যাকবলিত। তারা প্রয়োজনীয় ত্রাণ বিতরণ করছেন। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সহায়তার জন্য ২৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি উপজেলায় দেওয়া হয়েছে ২০ মেট্রিক টন করে। চারটি পৌরসভায় দেওয়া হয়েছে ৩০ মেট্রিক টন। এ ছাড়া নগদ ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বিতরণ করা হচ্ছে। এদিকে তাহিরপুরে বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি জনজীবন বিপর্যস্ত প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম বন্যাদুর্গত মানুষজন তাদের গৃহপালিত গবাদিপশুসহ পরিবার পরিজন নিয়ে পরেছেন চরম ভোগান্তিতে।
সেই সঙ্গে বন্যার চরম অবনতি হওয়ার পরও উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো খোলা থাকায় স্কুল পড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এমন দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াও ছোট ছোট নৌকা নিয়ে পাঠা দানের স্কুলে যাচ্ছে। যার ফলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটে প্রাণ হারানোর আতংকে দিন কাটছে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের। পাশাপাশি প্রবল বজ্রপাত ঘটার ফলে এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হাওরাঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িকী বন্ধ রাখা দাবি জানিয়েছেন স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকগণ।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার(১৬ জুন) সকাল থেকেই সীমান্ত নদী যাদুকাটা দিয়ে বিপদ সীমার ১.৬ মি.মি উপর দিয়ে ঢলের পানিতে আবারও তাহিরপুর উপজেলায় নতুন করে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে। জেলার সবকয়টি নদ নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে প্লাবিত হয়েছে উপজেলার নতুন নতুন গ্রাম। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আরও জানান, এমন ভারি বৃষ্টিপাত ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আরও ২/৩ দিন থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে যাদুকাটা নদীর পানির প্রবল স্রোতের নদী বাড়ের ঘাগটিয়া, রাজারগাও, লামাশ্রম, বিন্নাকুলী, গরকাঠি, ঘাগড়া, পাঠানপাড়া, ছড়া, সোহালা, মোদেরগাও, মাহাতাবপুর, দক্ষিনকুল, আনোয়ারপুর, বালীজুরি, লোহাছুরা গ্রাম ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিয়ানমার, মনবেগ গ্রামসহ দুই উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম ভাঙ্গনের হুমকিতে রয়েছে। জেলার তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের শক্তিয়ারখলা, আনোয়ারপুর, বালিজুরীসহ আরও কয়েকটি স্থান প্লাবিত হওয়ায় যান চলাচল বন্ধ আছে।
বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্যায় প্লাবিত হয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এসব এলাকার গ্রামীণ ছোট ছোট রাস্তা ঘাট, ব্রীজ, কার্লভাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এদিকে যাদুকাটা নদীর প্রবল স্রোতের তোড়ে বিন্নাকুলী বাজার সংলগ্ন যাদুকাটা নদীর উপর নির্মাণাধীন শাহ আরেফিন(রঃ) ও অদ্বৈত সেতুর গার্ডার ভেঙে পরে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রাহান কবির বলেন, প্রবল বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে বর্তমানে তাহিরপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ব্যপক অবনতি দিকে যাচ্ছে। তাহিরপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাহিরপুর উপজেলায় পর্যটকবাহী সকল নৌযানের চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলায় স্কুল কাম আশ্রয় কেন্দ্র ৩৩ টি ও ৩ আশ্রম কেন্দ্রসহ মোট ৩৩ টি আশ্রয় কেন্দ্র সার্বক্ষণিক খোলা রয়েছ। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তাহিরপুর উপজেলার বন্যাদুর্গতদের জন্য ৩৩ মে.নট খাদ্য সামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বরাদ্দকৃত খাদ্য সামগ্রী প্রতিটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের মাধ্যমে বন্যাদুর্গতদের বিতরণের কার্যক্রম চলছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গন বন্যাদুর্গত মানুষদের মধ্যে উক্ত খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন। এছাড়া বন্যাদুর্গত মানুষের যেখানে সমস্যায় কন্ট্রোলরুমের দেয়া মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করার অনুরোধ করেন ইউএনও রাহান কবির। সেই সাথে ব্যপক বজ্রপাত ঘটায় এই দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশে উপজেলার সকলেই ঘর থেকে বাহির না হওয়া সহ মনে সাহস নয়ে বন্যা মোকাবেলার আহবান জানিয়েছেন।
টানা বৃষ্টির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছেন। দীর্ঘ ১৫ দিন যাবত আয় রোজগার বন্ধ রয়েছে। শহরের বানভাসি মানুষ উচ্চ মূল্যে নৌকাভাড়া করে শহরের প্রাণ কেন্দ্রে যাতায়াত করছেন। শহরের সব কটি শপিংমল পানিতে প্লাবিত হয়েছে। হাসপাতাল কমিউনিটি ক্লিনিক, সহ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে বানের পানি ডুকে পড়েছে। শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে আছে৷ গ্রামের মানুষ গবাদিপশু হাঁসমুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।