গজলডোবার গেট খুলে দেয়ায় উজানের ঢল এবং বর্ষণে তিস্তার পানি ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার বাড়ন্ত পানি ঢুকেছে অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে বাসাবাড়িতে। তলিয়ে গেছে বাদামসহ উঠতি ফসল।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব জানিয়েছেন, বৃষ্টিপাত এবং উজানের ঢলের কারণে ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তায় বুধবার রাত ৯টা থেকে তৃতীয় দফায় পানি বেড়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে তা বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এই পানি বিকেলে কিছুটা কমে রাতে আবারো বিপদসীমার অনেক ওপরে থাকবে।
পাউবোর এই কর্মকর্তা আরো তিনি জানান, ‘এই পূর্বাভাস আমরা দুই সপ্তাহ থেকে সংশ্লিষ্টদের জানাচ্ছি। যাতে নদী অববাহিকার লোকজন নিরাপদে অবস্থান নিতে পারেন। গবাদিপশুসহ অন্যান্য জিনিস সরিয়ে নিতে পারেন।’
এদিকে রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘন্টায় রংপুর অঞ্চলে ৩৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা এবং নদীপাড়ের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, তিস্তায় পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়ায় নীলফামারীর ডিমলার ছাতনাই এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে। কোথাও কোথাও কোনো কোনো বাড়িতে কোমর অবদি পানি ঢুকেছে। এসব এলাকার উঠতি বাদাম, আমনের চারা, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যাচ্ছে পানির তোড়ে। দুর্গত এলাকায় মানুষজন খুবই বিপাকে পড়েছেন। কোথাও কোনো সহযোগিতা পৌঁছায়নি। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের কষ্ট বেশি। গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে কৃষকরা।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় দেখা গেছে, গঙ্গাচড়ার শেখ হাসিনা তিস্তা সেতু এলাকায় নিজেই মাইকিং করে এলাকাবাসীকে পানি বৃদ্ধির সতর্কতা জানাচ্ছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদি। তিনি মাইকিং করে এলাকাবাসীকে আশ্রয়ন কেন্দ্র এবং উঁচু স্থানে অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
চেয়ারম্যান হাদি জানান, ‘সকাল থেকে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে যাওয়ায় আমরা মাইকিং করছি। আমার ইউনিয়নের পাঁচটি ওয়ার্ডের ইতোমধ্যেই ১ হাজার বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। সেখানে যারা বৃদ্ধ নারী ও শিশু আছে, তাদেরকে আমরা রেসকিউ (উদ্ধার) করে নিরাপদ স্থানে আনছি। কারণ গত বছর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। এবার যেন সেটি না হয় সেজন্য আমরা বিভিন্ন পয়েন্ট করে নৌকায় এই কার্যক্রম চালাচ্ছি।’
তিনি স্বীকার করে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পানিবন্দি কোনো মানুষকে আমরা সহযোগিতা করতে পারিনি। তবে ইউএনও মহোদয়কে জানানো হয়েছে। আমরা সরকারের ওপর ভরসা করে থাকবো না। আগামীকাল থেকে আমরা নিজস্ব তহবিল থেকে পানিবন্দি মানুষের কাছে শুকনা খাবার পৌঁছে দিবো।’
স্থানীয় ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মনেয়ারুল ইসলাম জানান, ‘আমরা নৌকা দিয়ে বৃদ্ধ ও শিশুদের উঁচুতে নিয়ে আসছি। কোনো সহযোগিতা করতে পারি না। ওপরে জানিয়েছি। তারা এখন পর্যন্ত আসেওনি।’
পানিবন্দি পশ্চিম ইচলি এলাকার বয়োঃবৃদ্ধা ফাতেমা জানালেন, ‘হামরা ১৫ দিন থাকি পানিত। নেম্বর -চেয়ারম্যান কেউ আইসে নাই। বাচি আচি না মরি গেছি কেউ পুসও করে নাই। তোমরা গুলি খালি ফটো তুলি নিয়া যান, হামার গুলার জইন্যে কিছু করেন।’
একই এলাকার পানিবন্দি নাসিমা বেগমের বাড়ি নদী থেকে আর ৫ গজ দূরত্বে। যেটুকু বাড়িঘর আছে সেটুকুই দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তিনি জানালেন, ‘হামার আর কিচুই থাইকলো না। ঘরকোনা সরে নিয়া যাওসি। চেয়ারম্যান বান্দোদ ঘর কোনা তুইলার কইছে। ওট্টই নিয়া যায়া থোমো। রাইত কোনা যে কি হয়।’
এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড বাংলা ছাড়া আর মহিপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আপৎকালীন বালুভর্তি জিও ব্যাগ রেখে দিয়েছেন। সম্ভাব্য ভাঙ্গন ঠেকাতে এসব জিও ব্যাগ আগাম মজুদ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো। এছাড়াও বিনবিনিয়ায় দুটি স্থানীয়দের দেয়া বাঁধ আটকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁশের স্পার ও জিও টিউব ব্যাগ ফেলছে।