ভারত সরকার আচমকা গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার বাজে অভিজ্ঞতায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে আমদানিকারকদের মধ্যে। দেশটি চাল রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, এমন আশঙ্কায় এর কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে বিদেশি ক্রেতারা। ভারতের চারজন চাল রপ্তানিকারকের বরাতে সোমবার (৬ জুন) এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
খবরে বলা হয়েছে, গত দুই সপ্তাহে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা ১০ লাখ টন চাল রপ্তানির চুক্তি করেছেন। এসব চাল পাঠানো হবে চলতি জুন মাস থেকে আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। পাশাপাশি, ভারত যদি চাল রপ্তানি নিষিদ্ধও করে, তবু যেন এসব চালান না আটকায়, তার জন্য অল্প সময়ের মধ্যে ঋণপত্র (এলসি) খোলার হারও বেড়েছে।
ভারত চলতি বছরে এরই মধ্যে প্রায় ৯৬ লাখ টন চাল রপ্তানি করেছে। ২০২১ সালেও রেকর্ড পরিমাণ চাল রপ্তানি করেছিল দেশটি। তবে সাম্প্রতিক বেচাকেনা বেড়ে যাওয়ায় আগামী মাসগুলোতে ভারতীয় চালের অন্য ক্রেতাদের জন্য সরবরাহ কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চাল আমদানিকারকরা সাধারণত বর্তমান ও পরবর্তী মাসের জন্য চুক্তি করে থাকেন। তবে ভারতের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সত্যম বালাজির নির্বাহী পরিচালক হিমাংশু আগরওয়াল বলেছেন, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা তিন থেকে চার মাসের আগাম অর্ডার দিয়েছেন এবং ব্যবসার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে প্রত্যেকেই এলসি খুলেছেন।
ভারত থেকে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম-থাইল্যান্ডের চালের চাহিদা কমে যেতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। চাল উৎপাদনে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় এবং রপ্তানিতে প্রথম। ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড যথাক্রমে চালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক। তবে বৈশ্বিক রপ্তানিতে ভারতের সঙ্গে তাদের ব্যবধান আকাশ-পাতাল।
বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ চাল একাই রপ্তানি করে ভারত। বিপরীতে বিশ্বের মোটা চাল উৎপাদনে প্রায় ১০ শতাংশ এবং বৈশ্বিক রপ্তানিতে মাত্র ২৬ শতাংশ অবদান রাখে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।
গম রপ্তানি নিষিদ্ধ
গত মাসে ভারতের গম রপ্তানি নিষিদ্ধের ঘোষণায় অবাক হতভম্ব হয়ে পড়েন আমদানিকারকরা। এর কিছুদিন পর চিনি রপ্তানিতেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করে দেশটি। ভারত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গম রপ্তানিকারক না হলেও চিনি রপ্তানিতে তাদের অবস্থান দ্বিতীয়।
ভারত এসব বিধিনিষেধ আরোপের জেরে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়, দেশটি চাল রপ্তানিতেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পারে। যদিও ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত মজুত ও স্থানীয় বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকায় এই মুহূর্তে চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের।
গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতের বন্দরগুলোতে প্রচুর পরিমাণে শস্য আটকে পড়েছিল। কারণ, নয়াদিল্লি কেবল এলসি করা চালানগুলোকেই বন্দরত্যাগের অনুমতি দিয়েছে।
আগারওয়াল বলেন, মানুষ সাধারণত জাহাজ নির্বাচন করলেই এলসি খোলে। কিন্তু এখন ক্রেতারা চালের সব চুক্তিতেই এলসি খুলছেন, যেন রপ্তানি নিষিদ্ধ হলেও চুক্তিবদ্ধ চালান বাইরে যেতে পারে।
দামে সস্তা
অল ইন্ডিয়া রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বি ভি কৃষ্ণা রাও বলেন, বিদেশি ক্রেতারা ভারতীয় চাল নেওয়ার কারণ, এটি প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় অনেক সস্তা।
ডিলাররা জানিয়েছেন, ভারতের পাঁচ শতাংশ ভাঙা চালের দাম প্রতি টন ৩৩০ থেকে ৩৪০ মার্কিন ডলার (২০ হাজার ২৮০ টাকা থেকে ৩১ হাজার ১৯৮ টাকা প্রায়)। সেখানে থাইল্যান্ডের চালের দাম প্রতি টন ৪৫৫ থেকে ৪৬০ মার্কিন ডলার (৪১ হাজার ৭৫০ টাকা থেকে ৪২ হাজার ২০৯ টাকা প্রায়) এবং ভিয়েতনামের চালের দাম প্রতি টন ৪২০ থেকে ৪২৫ মার্কিন ডলার (৩৮ হাজার ৫৩৮ টাকা থেকে ৪১ হাজার ৪৭৫ টাকা প্রায়)।
একটি বৈশ্বিক ট্রেডিং হাউজের নয়াদিল্লি-ভিত্তিক ডিলার বলেছেন, ভারত রপ্তানি কমিয়ে দিলেই বিশ্বব্যাপী চালের দাম দ্রুত বাড়তে পারে। তার কথায়, অন্যদের তুলনায় ভারতীয় চাল অন্তত ৩০ শতাংশ সাশ্রয়ী। ভারত রপ্তানি সীমাবদ্ধ করলে এশিয়া-আফ্রিকার দরিদ্র ক্রেতারা বাড়তি দামে চাল কিনতে বাধ্য হবে। সে কারণেই ভারতীয় চাল কিনতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে।
ভারতীয় অ-বাসমতি চালের প্রধান ক্রেতা বাংলাদেশ, চীন, বেনিন, ক্যামেরুন, নেপাল, সেনেগাল এবং টোগো। আর তাদের সুগন্ধি বাসমতি চাল কেনে মূলত ইরান ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলো।
২০২১ সালে ভারত রেকর্ড ২ কোটি ১৫ লাখ টন চাল রপ্তানি করেছিল, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড সম্মিলিতভাবে করে মাত্র ১ কোটি ২৪ লাখ টন।