জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিতে আজ বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইবেন। আদালত থেকে দলের নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘুরে গুলশানের বাসায় ফিরতে পারেন খালেদা জিয়া। নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে গুলশানের নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন তিনি। ৯২ দিনের মাথায় কার্যালয় থেকে বের হবেন খালেদা জিয়া। তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া ও চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র গতকাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘খালেদা জিয়া কাল (রোববার) আদালতে যাবেন। উনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, উনি জামিন চাইবেন।’ এর আগে সকালে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থানরত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনার আদালতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটা নির্ভর করছে সকালের পরিস্থিতির ওপর।’ তবে বৃহস্পতিবার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আদালতে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়া আদালতে যেতে ইচ্ছুক। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা পেলে ৫ই এপ্রিল আদালতে যাবেন খালেদা জিয়া।’ এদিকে খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরার দিন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ‘রাজপথে অবস্থান’ কর্মসূচি ঘোষণায় উদ্বিগ্ন বিএনপি। শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের সম্মেলন থেকে শাজাহান খান ঘোষিত এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়ার আদালতে যাওয়া ও ফেরার পথে যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য সরকারের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছে দলটি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেছেন, সর্বশেষ আদালতে হাজিরার দিন খালেদা জিয়ার গাড়িবহর ও বিএনপি নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হয়েছিলেন। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তিনি যে কোন সময় হামলার শিকার হতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। মাহবুবুর রহমান বলেন, আশাকরি খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার বিষয়টি সরকার দেখবে। আমাদের কাছে এখন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তাটিই প্রধান বিষয়। জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। খালেদা জিয়ার পক্ষে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের আবেদন করা হলেও ৪ঠা মার্চ সে আবেদন নাকচ করে ৫ই এপ্রিল শুনানির দিন ঠিক করে দেন বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। এদিকে বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এ দুই মামলা অন্য আদালতে স্থানান্তরের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে করা খালেদা জিয়ার একটি আবেদনেরও এপ্রিলেই শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
৯২ দিন পর কার্যালয়ের বাইরে
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল ঘোষিত ৫ই জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৩রা জানুয়ারি বিকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয় খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সন্ধ্যার পর নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান তিনি। সেখানেও বাড়ানো হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। রাত ১০টায় খালেদা জিয়া খবর পান নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত দলের দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খবর পেয়ে তিনি কার্যালয় থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বাইরে তাৎক্ষণিকভাবে মোতায়েন করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। সেই সঙ্গে তার কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় দুইপাশে দেয়া হয় ব্যারিকেড। একপর্যায়ে দুইপাশে আড়াআড়িভাবে ১১টি বালু, ইট ও মাটিভর্তি ট্রাক রেখে অবরুদ্ধ রাখা হয় কার্যালয়। এভাবেই কার্যালয়ে দীর্ঘ অবস্থানের শুরু হয় খালেদা জিয়ার। এরপর একে একে ঘটে গেছে নানা নাটকীয় ও বিয়োগান্তক ঘটনা। ব্যারিকেডের পর তালা লাগিয়ে দেয়া হয় তার কার্যালয়ের মূল ফটকে। ৫ই জানুয়ারি ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে গাড়িতে ওঠে বেরুতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে সেখানে দাঁড়িয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। এ সময় তার ওপর পেপার স্প্রে ছুড়ে পুলিশ। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু ১৯শে জানুয়ারি ভোররাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে অবরোধ তুলে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে কার্যালয়ের তিনদিকে কিছু দূরে পুলিশ মোতায়েন ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের তৎপরতা অব্যাহত রাখা হয়। সেদিনই দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর প্রতি সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। পুলিশের ব্যারিকেড তুলে নেয়া হলেও কৌশলগত কারণে কার্যালয় ছেড়ে যাননি তিনি। তবে ২২শে জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়কে কেন্দ্র করে সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠন নানা ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করে। ওদিকে ২৪শে জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দীর্ঘদিন কারাভোগের পর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ড এবং পরে মালয়েশিয়া যান কোকো। ছোট ছেলের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। ওই দিন রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে তার কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, অপ্রস্তুতিসহ নানা কারণে তাকে অভ্যর্থনা জানাননি বিএনপি নেতারা। ওদিকে খালেদা জিয়া যখন ছেলে হারিয়ে শোকাহত তখনই তাকে হুকুমের আসামি করে করা হয় একের পর এক মামলা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় করা গাড়ি পোড়ানো মামলায় হুকুমের আসামি করা হয় খালেদা জিয়াকে। ৩০শে জানুয়ারি খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে যান গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। ৩০শে জানুয়ারি শেষ রাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, কেবল টিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় সরকার। কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর সেখানে অবস্থানকারী দলের নেতা ও কর্মকর্তাদের তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন যত কিছুই হোক কার্যালয় ছাড়বেন না। নানা মহলের সমালোচনার মুখে ১৯ ঘণ্টা পর তার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। ৩১শে জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ অভিযোগ করেন খালেদাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। ২রা ফেব্রুয়ারি অবরোধ ও হরতালে ৪২ জনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে খালেদা জিয়া ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদকে আসামি করে নালিশি মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী। পরদিন ৩রা ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় দফায় কড়াকাড়ি আরোপ করা হয় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করার একপর্যায়ে ওই সংগঠনের মফিজুল নামে এক নেতা পিস্তল হাতে কার্যালয়ের দিকে ছুটে যান। ৯ই ফেব্রুয়ারি নিজেদের সংলাপের উদ্যোগ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়াকে একটি চিঠি দেয় নাগরিক সমাজ। ১০ই ফেব্রুয়ারি বিকালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গুলশান কার্যালয়ে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। ১১ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অবস্থানকারীদের জন্য নেয়া খাবার ভ্যানটি ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। এরপর থেকে খালেদা জিয়া ছাড়া কার্যালয়ে অবস্থানকারীদের জন্য খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। কার্যালয়ের গেটে একটি টেবিল ও খাতা-কলম নিয়ে বসেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যরা। কার্যালয়ের আশপাশের দূতাবাসের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই এলাকায় সচল করা হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক। এরপর সরকারপন্থি সংগঠনগুলো প্রতিদিন গুলশান এলাকায় বিক্ষোভ করতে থাকে। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সময় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই সময় কুমিল্লা, খুলনা ও পঞ্চগড়েও কয়েকটি মামলা হয়। এদিকে সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি দেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। বিএনপির তরফে সে চিঠির জবাবও দেয়া হয়। ২৫শে ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ১লা মার্চ গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশির অনুমতি দেন আদালত। এ সময় তাকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে নানা গুঞ্জন ছড়ায় রাজনৈতিক মহলে। তবে খালেদা জিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে কোন পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন তিনি। গ্রেপ্তারের গুঞ্জনের মধ্যেই ৩রা মার্চ অনেকটা নাটকীয়ভাবেই গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ১৬ কূটনীতিক। ১১ই মার্চ আত্মগোপনে থেকে দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনকারী যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন। ১৩ই মার্চ সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া ঘোষণা দেন যৌক্তিক পরিণতি পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আরাফাত রহমান কোকোর সোনালী ব্যাংকের একটি ঋণসংক্রান্ত মামলায় ১৬ই মার্চ খালেদা জিয়া ও কোকোর দুই মেয়েকে বিবাদী করা হয়। ১৮ই মার্চ নির্বাচন কমিশন ঢাকা ও চট্টগ্রাম তিন সিটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে একদিন পর প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদসহ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে জানান বিএনপি নির্বাচনে ইতিবাচক। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়। এদিকে চলমান আন্দোলন কর্মসূচির কারণে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজের রাজনৈতিক কার্যালয় ছেড়ে বের হননি খালেদা জিয়া। এমনকি ছেলের মৃত্যুর ঘটনায়ও তিনি ঘোষিত কর্মসূচি শিথিল করেননি। কর্মসূচির কারণে ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার ও ২৬শে মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধেও শ্রদ্ধা জানাতে যাননি তিনি। অবশেষে আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে ৯২ দিন পর কার্যালয় থেকে বের হচ্ছেন তিনি।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল ঘোষিত ৫ই জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৩রা জানুয়ারি বিকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো হয় খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সন্ধ্যার পর নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান তিনি। সেখানেও বাড়ানো হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। রাত ১০টায় খালেদা জিয়া খবর পান নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত দলের দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খবর পেয়ে তিনি কার্যালয় থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বাইরে তাৎক্ষণিকভাবে মোতায়েন করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। সেই সঙ্গে তার কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় দুইপাশে দেয়া হয় ব্যারিকেড। একপর্যায়ে দুইপাশে আড়াআড়িভাবে ১১টি বালু, ইট ও মাটিভর্তি ট্রাক রেখে অবরুদ্ধ রাখা হয় কার্যালয়। এভাবেই কার্যালয়ে দীর্ঘ অবস্থানের শুরু হয় খালেদা জিয়ার। এরপর একে একে ঘটে গেছে নানা নাটকীয় ও বিয়োগান্তক ঘটনা। ব্যারিকেডের পর তালা লাগিয়ে দেয়া হয় তার কার্যালয়ের মূল ফটকে। ৫ই জানুয়ারি ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে গাড়িতে ওঠে বেরুতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে সেখানে দাঁড়িয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। এ সময় তার ওপর পেপার স্প্রে ছুড়ে পুলিশ। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু ১৯শে জানুয়ারি ভোররাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে অবরোধ তুলে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে কার্যালয়ের তিনদিকে কিছু দূরে পুলিশ মোতায়েন ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের তৎপরতা অব্যাহত রাখা হয়। সেদিনই দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর প্রতি সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। পুলিশের ব্যারিকেড তুলে নেয়া হলেও কৌশলগত কারণে কার্যালয় ছেড়ে যাননি তিনি। তবে ২২শে জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার কার্যালয়কে কেন্দ্র করে সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠন নানা ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করে। ওদিকে ২৪শে জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দীর্ঘদিন কারাভোগের পর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ড এবং পরে মালয়েশিয়া যান কোকো। ছোট ছেলের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। ওই দিন রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে তার কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, অপ্রস্তুতিসহ নানা কারণে তাকে অভ্যর্থনা জানাননি বিএনপি নেতারা। ওদিকে খালেদা জিয়া যখন ছেলে হারিয়ে শোকাহত তখনই তাকে হুকুমের আসামি করে করা হয় একের পর এক মামলা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় করা গাড়ি পোড়ানো মামলায় হুকুমের আসামি করা হয় খালেদা জিয়াকে। ৩০শে জানুয়ারি খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে যান গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। ৩০শে জানুয়ারি শেষ রাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, কেবল টিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় সরকার। কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর সেখানে অবস্থানকারী দলের নেতা ও কর্মকর্তাদের তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন যত কিছুই হোক কার্যালয় ছাড়বেন না। নানা মহলের সমালোচনার মুখে ১৯ ঘণ্টা পর তার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। ৩১শে জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ অভিযোগ করেন খালেদাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। ২রা ফেব্রুয়ারি অবরোধ ও হরতালে ৪২ জনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে খালেদা জিয়া ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদকে আসামি করে নালিশি মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী। পরদিন ৩রা ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় দফায় কড়াকাড়ি আরোপ করা হয় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করার একপর্যায়ে ওই সংগঠনের মফিজুল নামে এক নেতা পিস্তল হাতে কার্যালয়ের দিকে ছুটে যান। ৯ই ফেব্রুয়ারি নিজেদের সংলাপের উদ্যোগ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়াকে একটি চিঠি দেয় নাগরিক সমাজ। ১০ই ফেব্রুয়ারি বিকালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গুলশান কার্যালয়ে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। ১১ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অবস্থানকারীদের জন্য নেয়া খাবার ভ্যানটি ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। এরপর থেকে খালেদা জিয়া ছাড়া কার্যালয়ে অবস্থানকারীদের জন্য খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। কার্যালয়ের গেটে একটি টেবিল ও খাতা-কলম নিয়ে বসেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যরা। কার্যালয়ের আশপাশের দূতাবাসের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই এলাকায় সচল করা হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক। এরপর সরকারপন্থি সংগঠনগুলো প্রতিদিন গুলশান এলাকায় বিক্ষোভ করতে থাকে। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সময় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই সময় কুমিল্লা, খুলনা ও পঞ্চগড়েও কয়েকটি মামলা হয়। এদিকে সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি খালেদা জিয়ার কাছে চিঠি দেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। বিএনপির তরফে সে চিঠির জবাবও দেয়া হয়। ২৫শে ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ১লা মার্চ গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশির অনুমতি দেন আদালত। এ সময় তাকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে নানা গুঞ্জন ছড়ায় রাজনৈতিক মহলে। তবে খালেদা জিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে কোন পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন তিনি। গ্রেপ্তারের গুঞ্জনের মধ্যেই ৩রা মার্চ অনেকটা নাটকীয়ভাবেই গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ১৬ কূটনীতিক। ১১ই মার্চ আত্মগোপনে থেকে দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালনকারী যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন। ১৩ই মার্চ সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া ঘোষণা দেন যৌক্তিক পরিণতি পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আরাফাত রহমান কোকোর সোনালী ব্যাংকের একটি ঋণসংক্রান্ত মামলায় ১৬ই মার্চ খালেদা জিয়া ও কোকোর দুই মেয়েকে বিবাদী করা হয়। ১৮ই মার্চ নির্বাচন কমিশন ঢাকা ও চট্টগ্রাম তিন সিটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে একদিন পর প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদসহ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে জানান বিএনপি নির্বাচনে ইতিবাচক। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়। এদিকে চলমান আন্দোলন কর্মসূচির কারণে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজের রাজনৈতিক কার্যালয় ছেড়ে বের হননি খালেদা জিয়া। এমনকি ছেলের মৃত্যুর ঘটনায়ও তিনি ঘোষিত কর্মসূচি শিথিল করেননি। কর্মসূচির কারণে ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার ও ২৬শে মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধেও শ্রদ্ধা জানাতে যাননি তিনি। অবশেষে আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে ৯২ দিন পর কার্যালয় থেকে বের হচ্ছেন তিনি।