কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে বেশির ভাগ মানুষের আয় কমেছে। বেড়েছে বেকার ও দরিদ্রের সংখ্যা। টিকে থাকতে সঞ্চয়ের টাকা খরচ করে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক মানুষ। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে লড়াই করছেন এসব মানুষ। কিন্তু বাদ সেধেছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সবাই। এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার দশা। অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের পেছনে খরচ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট করতে। এতে বাদ পড়ে যাচ্ছে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, কলা ও বেকারি পণ্যের মতো অনেক ধরনের খাবার।
মূল্যস্ফীতির চাপে সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছেন নিম্ন ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। তাদের কাতারে শামিল হয়েছে মধ্যবিত্তও। কারণ চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, দুধ, ডিম, মসলা, তরিতরকারিসহ বাজারের বেশির ভাগ পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের পকেট আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না। করোনাকালে গরিবের টিসিবি
পণ্যের ট্রাকের লাইনে মধ্যবিত্তের মুখ লুকিয়ে দাঁড়াতে দেখা গেছে। বর্তমানে সেই টিসিবির ট্রাক সেলও বন্ধ। নিরুপায় হয়ে বাজার থেকেই বেশি দামে তেল, চিনি, ডাল কিনতে হচ্ছে তাদের। একেবারেই না হলে নয়, এমন পণ্যের পেছনেই অর্থ ব্যয় করছেন বেশির ভাগ মানুষ।
মালিবাগ বাজারে গতকাল বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. আনিস রহমান বলেন, ‘আমাদের মতো স্বল্প বেতনের মানুষের পক্ষে পরিবার নিয়ে খেয়ে-পরে টিকে থাকাটাই এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেতনের ত্রিশ হাজার টাকা থেকে বাসা ভাড়া ও গাড়ি ভাড়া দিয়ে যা থাকে, তা দিয়ে মাসের চাল, ডাল, তেল, চিনি, মসলা কিনতেই হিমশিম খেতে হয়। সেখানে মাছ-মাংস কিনে খাওয়া দূরে থাক, দুধ-ডিম কিনে খাওয়াটাও বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। বাধ্য হয়েই এগুলো এখন কেনা বন্ধ করে দিয়েছি। বাচ্চার জন্য গুঁড়াদুধটা যে কিনব, সেটাও কুলিয়ে উঠতে পারছি না।’
একই বাজারে কথা হয় আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সিরাজুল ইসলামে সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, ছোট চিংড়ির দাম এখন সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় নিরামিষ তরিতরকারি খাচ্ছে তার পরিবার। তিনি বলেন, ‘আগে ৫০০ টাকা কেজি দরে ছোট চিংড়ি পাওয়া গেলেও এখন ৬৫০ টাকার নিচে মেলে না। তেলাপিয়ারও দাম বেড়ে গেছে। আগে পাঙ্গাশ মাছ খেতাম না। অন্য মাছের যে দাম, তাতে বাধ্য হয়ে পাঙ্গাশ মাছ খাচ্ছি।’
দুপুরের ভাতের খরচ বাঁচাতে আগে রুটি, কলা আর চা খেয়ে কাটিয়েছেন রিকশাচালক মিজানুর রহমান। কিন্তু এখন সেখানেও টান পড়েছে বলে জানান তিনি। মিজানুর বলেন, ‘করোনার সময় ৫ টাকার বনরুটি, ৮ টাকায় একটা কলা আর ৫ টাকায় এক কাপ চা খাইয়া দুপুর পার করছি। খরচ পড়ত ১৮ টাকা। অহন খরচ পড়ে ২৫-৩০ টাকা। সবচেয়ে বেশি বাড়ছে কলার দাম। তাই অহন ৮ টাকার একটা বনরুটি ৫ টাকার চায়ে ডুবাইয়া খাই। কলা আর খাই না।’
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বাঁচাতে আহার কমিয়ে দিয়েছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর মো. আলতাফ মিয়াও। কারওয়ানবাজারের এ দিনমজুর জানান, চাল, ডাল, তেল, নুন আর কয়টা সবজি দিয়ে পরিবার নিয়ে কোনো রকমে আধপেট খেয়ে দিন পার করছেন তিনি। শেষ কবে গরুর মাংস কিংবা ভালো মাছ খেয়েছেন, মনে করতে পারছেন না। প্রবীণ আলতাফ বলেন, ‘গরুর মাংস খাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। আগে মাঝেমধ্যে ফার্মের মুরগি খাইতাম, অহন দেড় কেজির একটা মুরগি কিনতে গেলেও আড়াইশ টাকার মতো খরচ পড়ে। এখন ডিমের হালিও ৪২ টাকা হইছে। এসব জিনিস এখন আর কিনা খাইতে পারি না।’
বেসরকারি চাকরিজীবী আনিস, সিরাজুল কিংবা খেটে খাওয়া মজদুর মিজানুর ও আলতাফের মতো মূল্যস্ফীতির চাপে বিপর্যস্ত আরও অনেকে। দফায় দফায় বাজারে খরচ কেবল বাড়ছেই। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে টানা ছয় মাস বাড়ার পর জানুয়ারিতে কমেছিল এই সূচক। ফেব্রুয়ারি থেকে তা আবার চড়ছে। এপিলে তা বেড়ে বিগত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ চূড়ায় ঠেকেছে। এপ্রিল মাসে ৬ দশমিক ২৯-এ উঠেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। অর্থাৎ ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে যে পণ্য বা সেবার জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের এপ্রিলে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৬ টাকা ২৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এর আগের মাস মার্চে এই হার ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও জীবনযাত্রায় এর প্রভাব প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্র্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে এবং এর চাপ সামলাতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী হিমশিম খাচ্ছে। বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতি রয়েছে, তার উৎস আসলে বৈদেশিক পরিস্থিতি। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মতো দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। যখন বহির্বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তখন অভ্যন্তরীণ নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি ঠেকানো খুব একটা সম্ভব না। তবে মূল্যস্ফীতির ফলে যারা বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের কিছুটা হলেও আমরা কীভাবে সুরক্ষা দিতে পারি, সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। দরিদ্রদের জন্য সরকার যে পণ্য সরবরাহ করছে, তার পরিধি বাড়ানোসহ ক্ষতিগ্রস্তদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, সে বিষয়টি আসা উচিত। এ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন এবং এটা যাতে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।’
গত এক বছরে রাজধানীর বাজার চিত্র ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বছরের ব্যবধানে যেসব পণ্যের দাম অত্যধিক হারে বেড়েছে সেগুলোর মধ্যে প্রতিকেজি গরুর মাংসের দাম ১১০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত এবং ব্রয়লার মুরগির দাম অন্তত ৩০ টাকা বেড়েছে। যদিও কিছুদিন আগেও ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার এ ব্যবধান ছিল ৫০ টাকা। চলতি সপ্তাহে এ মুরগির দাম কমেছে। অপরদিকে দুই কেজির প্যাকেট আটার দাম বেড়ে এখন হয়েছে ৯৮ টাকা। এক কেজি আটা কিনতে গেলেও খরচ পড়ছে ৫০ টাকার বেশি। গত বছর এ সময় যা কেনা গেছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকায়। গুঁড়াদুধের দামও অত্যধিক বেড়েছে। ডিপ্লোমা ব্র্যান্ডের এক কেজির প্যাকেট এখন ৭৯০ টাকা। এক বছর আগে এ দুধ কেনা গেছে ৬৫০ টাকায়। ডিমের হালি এখন ৪২ টাকা হয়েছে, বছর খানেক আগেও পাওয়া গেছে ৩০ টাকায়। বোতলজাত সয়াবিনের বোতলের লিটারের দামও ঠেকেছে ২০০ টাকায়। গত বছর ১৫০ টাকাতে কেনা গেছে এ বোতল। বাজারে পাম তেলের দামও ভোগাচ্ছে অনেক। এ ছাড়া বছরের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এক বছরে মসুর ডাল (ছোট দানা) কেজিতে ৩০ টাকা বেড়েছে। খোলা চিনির দাম কেজিপ্রতি ৮ টাকা বেড়েছে। আমদানিকৃত রসুনের দামও বছরের ব্যবধানে ৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
বেকারি পণ্যের মধ্যে আধা পাউন্ড পাউরুটির দাম এখন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। গত বছর এমন সময়ে যা পাওয়া গেছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। প্লেন কেকের পাউন্ড এখন ১০০ টাকা, গত বছর যা ৬০ টাকা ছিল। এ ছাড়া খোলা বিস্কুটের কেজি এখন ১৮০ থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে। বছরখানেক আগে ১১০ টাকাতেও বিস্কুট পাওয়া গেছে। অপরদিকে হঠাৎ করে লাগামছাড়া কলার বাজার। সাগর কলার ডজন এখন ১৪০ থেকে ১৭০ টাকা। গত বছর এমন সময় যা ১১০ থেকে ১২০ টাকায় পাওয়া গেছে।
করোনায় চাকরি হারিয়ে এখন রাজধানীর ফার্মগেটের একটি মেসে থেকে চাকরির সন্ধান করছেন মো. হাসনাইন উজ্জ্বল। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় বেকার জীবন আরও কষ্টকর হয়ে উঠেছে তার। উজ্জ্বল বলেন, একটা মুরগি কিনে ১৬ পিস করে মেসের সদস্যরা খাচ্ছি। মাছের পিসও ছোট করতে হচ্ছে। সাশ্রয় করতে ডাল আরও পাতলা হয়েছে। ডালে রসুন দেওয়াও বন্ধ করেছি। হোটেলে পরোটা-ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন শুধু ডাল-পরোটা খেতে হয়।
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ অনেক কষ্টে রয়েছে উল্লেখ করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই চলছে। বাংলাদেশও লড়ছে। দ্রব্যমূল্যের দাম যে বাড়ছে, সরকার সে বিষয়ে সচেতন। বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারি জোরদার, শুল্ক প্রত্যাহারসহ সম্প্রতি বিশেষ টিম গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়ের ঘাটতিতে এসব উদ্যোগের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। গরিবের চাল, ডাল, তেল, আটা কিনে খেতে কষ্ট করছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পরিকল্পনা যেমন থাকতে হবে, তেমনি গরিবের আহার কীভাবে জোগাড় হবে, সেদিকেও নজর দিতে হবে। এখন মধ্যবিত্তও কষ্টে রয়েছে, তাদের কথাও ভাবতে হবে।
আমাদের সময়কে তিনি আরও বলেন, ‘টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি পরিবারকে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। এটা ভালো উদ্যোগ। তবে এ ধরনের কর্মকা-ের পরিধি আরও বাড়াতে হবে। আসছে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সামান্য ডালভাত কিংবা আটা কিনতে দরিদ্ররা এখন হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি গরিবের তিন বেলা আহার নিশ্চিতের দিকে সরকারকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।’