বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় আম ফজলির ভৈাগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের পাশাপাশি দুটি জেলা। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সেই দাবি নিয়ে আজ মঙ্গলবার পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতরে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
দেশের অনেক স্থানে ফজলি আম হয়ে থাকে। তবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ- এই দুটি জেলায় সবচেয়ে বেশি ফজলি আম উৎপাদিত হয়।
রাজশাহীর ফল গবেষণা কেন্দ্রের আবেদনের পর ২০২১ সালে ফজলি আমকে রাজশাহীর নিজস্ব পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করেছিল পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ সেই স্বীকৃতির বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে আপিল করে।
এ শুনানিতেই ফজলি আমের ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই স্বত্ত্বের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।
রাজশাহীর স্বীকৃতির আবেদন
উত্তরাঞ্চলীয় রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ‘ফজলি আম’কে রাজশাহীর নিজস্ব পণ্য হিসাবে স্বীকৃতির জন্য ২০১৭ সালে আবেদন করেছিল রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র।
সেই আবেদনের পর যাচাই-বাছাই শেষে ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর বাঘার ফজলি আমকে রাজশাহীর নিজস্ব আম হিসাবে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আলীম উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষীরসাপাত, ল্যাংড়া আর আশ্বিনা আমের জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়েছে। তখন আমরা ভেবে দেখলাম, পশ্চিমবঙ্গের মালদার ফজলি আম যেহেতু সে দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে, তাহলে আমাদের রাজশাহীর বাঘা ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতির জন্য আমরা আবেদন করতে পারি।’
তিনি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে ফজলি আম হয়, সেটার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মালদার ফজলি আমের মিল রয়েছে। কিন্তু রাজশাহীর বাঘায় যে ফজলি আম হয়, সেটা আকারে তুলনামূলক ছোট, স্বাদে আলাদা। অন্য ফজলি আমের সঙ্গে ওজনেও পার্থক্য রয়েছে। স্থানীয়ভাবেও এটির পুরনো ইতিহাস পাওয়া যায়। বিশেষ করে বাঘা শাহী মসজিদের টেরাকোটার কারুকাজেও ফজলি আমের ছবি রয়েছে।
এসব বিবেচনায় নিয়ে তারা বাঘার ফজলি আমের স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন।
এজন্য বাঘা ফজলি আমের ইতিহাস, দালিলিক প্রমাণপত্র ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল জমা দেয়া হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আপত্তি
জিআই পণ্যের স্বীকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, জার্নালে প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে কারো আপত্তি থাকলে জানাতে হবে। না হলে সেটির ভৌগলিক নির্দেশক সূচক কার্যকর হয়ে যাবে।
বাঘা ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতির বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতরে আপত্তি করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশন।
প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘সবচেয়ে বেশি ফজলি আম উৎপাদিত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। একে আপনি ফজলি আমের জন্মভূমি বলতে পারেন। এই জেলায় ফজলি আম হচ্ছে শত শত বছর ধরে। কিন্তু সেখানে ফজলি আমের স্বীকৃতি অন্য একটি জেলা পাবে, তা তো হয় না। এজন্য আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফজলি আমের স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করেছি।’
আমের জেলা হিসাবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত এক বছরে ৮৮ হাজার মেট্রিকটন ফজলি আম উৎপাদিত হয়েছে বলে তিনি জানান।
জিআই স্বত্ত্ব অধিকার ও গর্বের
মুনজের আলম বলেছেন, ফজলি আমের জিআই স্বত্ত্ব পাওয়ার বিষয়টিকে তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার একটি অধিকার ও গর্বের বিষয় বলে মনে করেন। তাই তারা আপত্তি জানিয়ে স্বীকৃতি চেয়েছেন।
তবে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আলীম উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, মালদার ফজলি আমকে এর মধ্যেই ভারতে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম মালদার আমেরই অংশ। ফলে তাদের ফজলি আমের স্বত্ত্ব পাওয়ার সুযোগ শেষ হয়ে গেছে।
‘এটিকে জিআই স্বীকৃতি দেয়া হলে ভারত তার বিরুদ্ধে মামলা করলে আমাদের স্বত্ত্ব বাতিল হয়ে যাবে,’ তিনি বলছেন।
২০০৮ সালে সালে ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মালদার ফজলি আমকে সেদেশের জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ফলে এই জাতীয় ফজলি আমের অন্য দেশে স্বীকৃতির সুযোগ নেই বলে কর্মকর্তারা বলছেন।
এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই তারা রাজশাহীর বাঘা ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতি চেয়েছেন। এই আমটি আকারে ছোট, মালদার ফজলি আম থেকে আলাদা করা যায় এবং বাঘা অঞ্চলে হয়ে থাকে বলে তিনি জানান।
কর্মকর্তারা বলছেন, ফজলি আম রাজশাহী বা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যে জেলাই জিআই পাক না কেন, সেটা আসলে বাংলাদেশের গর্ব।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাবে এখানে কোনো জেলার পক্ষে দাবি করার আলাদা কোনো কারণ নেই। কিন্তু যুক্তিসঙ্গত বা প্রমাণসাপেক্ষ না হলে সেই দাবি ভবিষ্যতে বাতিল হয়ে যেতে পারে।
তবে বাঘা ফজলি আম বলে বিশেষ কোনো আম নেই বলে দাবি করছেন মুনজের আলম মানিক।
তিনি বলছেন, এটিও ফজলি আম, সারা বাংলাদেশেই যেমন ফজলি আম হয়ে থাকে। রাজশাহীর আমও আলাদা কোনো ফজলি আম নয়। সুতরাং ফজলি আমকে কোনো জেলার পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হলে, সেটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পাওয়া উচিৎ।
মঙ্গলবার দুই জেলার দাবি নিয়ে শুনানি করবে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর।
সেখানে তাদের দাবির পক্ষে যুক্তির পাশাপাশি অন্যান্য প্রমাণপত্রও বিবেচনায় নেয়া হবে।
এরপর অধিদফতর তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।
ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই স্বত্ব পেলে কী হবে?
জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগলিক নির্দেশক স্বীকৃতি হলো কোনো পণ্যের ভৌগলিক পরিচয়।
কোনো একটি দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
কোনো পণ্য জি-আই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়।
এই পণ্যগুলোর আলাদা কদর থাকে।
ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়।
কর্মকর্তারা বলছেন, ফজলি আম বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক স্বীকৃতি পেলে সেটি রফতানিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বিশ্বে এই আমটি বাংলাদেশের আম হিসাবে পরিচিত পাবে। সেই সঙ্গে এটি উৎপাদনের বাণিজ্যিক ও আইনি সুরক্ষাও পাবে।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক অধিদফতর (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।
যে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জিআই এর জন্য আবেদন করেন সেটার মেধাস্বত্ত্ব তাদের দেয়া হয়।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়।
২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি।
এর আগে, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জিআই পণ্য হিসাবে ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পেয়েছিল জামদানি।
এরপর ২০১৭ সালে ইলিশ, ২০১৯ সালে ক্ষীরসাপাতি আম, ২০২০ সালে ঢাকাই মসলিন।
২০২১ সালে রাজশাহী সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, কালিজিরা চাল, দিনাজপুরের কাটারীভোগ চাল এবং নেত্রকোনার সাদামাটিকে জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি