বাজারে তীব্র সংকটের মধ্যেই নতুন করে বাড়ানো হয়েছে সয়াবিন তেলের দাম। এ দফায় বোতলজাত সয়াবিনের দাম এক ধাক্কায় প্রতি লিটারে ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে। রান্নায় ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় এ পণ্যটির দাম এত বাড়ায় হতবাক ভোক্তারা। তেল কিনতে গিয়ে এখনো বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে তাদের। বাজারে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ছুটেও তেল মিলছে না। বড় বাজারে হাতেগোনা কয়েকটি দোকানে বিক্রি হলেও পাড়া-মহল্লা, অলিগলির দোকানসহ বাজারের বেশিরভাগ দোকান থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেল উধাও। খুচরা কিংবা পাইকারি বিক্রেতা, কেউই বলতে পারছেন না- কোথায় গেলে মিলবে সয়াবিন তেলের সন্ধান!
রাজধানীর কদমতলী সাদ্দাম মার্কেট ও আশপাশের ১০টিরও বেশি দোকান ঘুরে এক বোতল সয়াবিন খুঁজে পাননি বেসরকারি চাকরিজীবী মো. আলতাফ হাওলাদার। অবশেষে এক দোকানে খোলা তেলের সন্ধান পেয়ে সেখান থেকে তেল কেনেন গিরিধারা এলাকার এ বাসিন্দা। আলতাফ বলেন, ‘বাজার ও পাড়া-মহল্লার কোনো দোকানেই সয়াবিনের বোতল পেলাম না। এক দোকানে ২০৮ টাকা কেজি দরে খোলা তেল পেলাম। ঠেকায় পড়ে কিনতে হলো। একদিকে এত দাম বাড়ানো হলো, আরেকদিকে তেল কিনতে এসে পেরেশান। কষ্টের টাকা দিয়ে তেলও কিনব, কষ্টও করব। ব্যবসায়ীদের হাতে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে আছি আমরা। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই।’ এ বাজারের মুদি দোকান ‘বৈশাখী জেনারেল স্টোরের’ মো. শাহজাহান আমাদের সময়কে বলেন, ‘নতুন দামের তেলের বোতল তো দূরে থাক, ২০ দিনেরও বেশি সময় হলো, আমরা কোম্পানির কাছ থেকে কোনো তেলের
বোতল পাই না। কোম্পানির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তেল কোথায়?’
একই অভিযোগ কারওয়ানবাজারের তেল কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. আজম আলীরও। তার অভিযোগ, ‘সয়াবিনের আমদানি তো আর থেমে নেই, কোম্পানিগুলো তো আর বন্ধ রাখা হয়নি। তা হলে এত তেল যায় কোথায়!’ আজম বলেন, ‘কিচেন মার্কেটের প্রায় ১৫টি দোকান ঘুরেছি। এক বোতলও পাইনি। খোলা তেলও নেই বললে চলে। বোতল তেলের আশা ছেড়ে এখন খোলা তেল কিনব ভাবছি।’
সয়াবিনের বোতল নেই কেন জানতে চাইলে কিচেন মার্কেটের ঢাকা জেনারেল স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মুজাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি ১৫ রোজার পর কোম্পানির কাছ থেকে কোনো বোতল পাইনি। গতকাল এ বাজারে পুষ্টি ব্র্যান্ডের এক গাড়ি তেল এসেছে। ব্যবসায়ীদের আগের রেট লেখা দুই লিটার ও পাঁচ লিটারের বোতল এক কার্টন করে দেওয়া হয়েছে। সিরিয়াল দিয়ে আমি তা পাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যাদের কাছে তেল আছে, তাদের এমআরপি রেটে কিনতে হয়েছে। এখন লাভ রেখে বিক্রি করতে গেলে নানা ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। এত ঝামেলা করে কে ব্যবসা করবে। তা ছাড়া খোলা তেলের দাম পাওয়া যায় বেশি। তাই অনেক ব্যবসায়ী বোতল ভেঙে বিক্রি করছেন।’
এদিকে সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেছেন ভোজ্যতেলের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘আমাদের সরবরাহ ঠিক আছে। খোঁজ নিয়ে দেখেন খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা কে কোথায় মজুদ করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও অপরিশোধিত পাম তেলের দামে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রয়েছে। তার ওপর ইন্দোনেশিয়া সয়াবিনের কাঁচামাল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ায় বাজার অনেক চড়া এখন। কেউ তো আর লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবে না। এতদিন রমজান উপলক্ষ্যে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়নি। ঈদের পর সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসে সয়াবিনের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করেই এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।’
ভোজ্যতেলের বাজারে এমন অস্থিরতা হঠাৎ শুরু হয়নি। শুরুটা হয় ২০২০ সালের শেষ দিকে। করোনার প্রকোপে বিশ্ববাজারের পাশাপাশি দেশীয় নিত্যপণ্যের বাজারেও অস্থিরতা দেখা দেয়। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বৈশ্বিক পণ্যবাজারে আরও উত্থান ঘটায়। উল্লেখ্য, বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার এত-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় এ দুটি দেশ। সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় চাপ পড়ে প্রধান দুটি ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিনের ওপর। অন্যদিকে গত এপিলের শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়া সয়াবিনের কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এ চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া আর্জেন্টিনাও রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক আগে থেকেই দাম বাড়ানোর চেষ্টা চালায় ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে রমজান মাস উপলক্ষে দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু ঈদের পর দাম বাড়ানো হবে -সে বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন ব্যবসায়ীরা। মূলত এ কারণেই কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে কিংবা অনেক পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা অনৈতিকভাবে তেল মজুদ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত বৃহস্পতিবার সয়াবিনের দাম ৩৮ থেকে ৪৪ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়, যা আজ শনিবার থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশের বাজারে একসঙ্গে এত মূল্যবৃদ্ধি এর আগে কখনো ঘটেনি।
দাম বাড়ার পর লুকিয়ে রাখা পুরনো দামে কেনা তেল বাজারে আসবে বলে ধারণা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু গতকাল শুক্রবার বাজারে তা দেখা যায়নি। রাজধানীর কদমতলী, রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী, মালিবাগ, কারওয়ানবাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দাম বাড়ার ঘোষণার পরেও বেশিরভাগ দোকানে সয়াবিনের বোতাল পাওয়া যাচ্ছে না। খোলা তেলেরও সংকট রয়েছে। বিক্রি হচ্ছে অতিরিক্ত দামে।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিয়মিত দাম সমন্বয় করতে না পারার কারণেই মূলত দেশে সয়াবিনের বাজারে এমন অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘সয়াবিনের বাজার সামাল দিতে সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। শেষমেশ উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর প্রত্যাহার করেছে, আমদানিতে কর কমিয়েছে। কিন্তু আমদানি ও সরবরাহের দিকে নজর দেওয়া হয়নি। উল্টো বলা হয়েছে সয়াবিনের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। যদি তাই হয় তা হলে সয়াবিন গেল কোথায়। আমদানি ও সরবরাহের তথ্যে অবশ্যই সরকারের নিবিড় নজরদারি থাকতে হবে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে কেউ অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়াতে পারবে না। প্রয়োজনে সরকার নিজেও আমদানি করে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পারে। পাশাপাশি নিয়মিত যুক্তিসংগতভাবে মূল্য সমন্বয় করতে হবে। দাম বাড়ানোর মতো সঠিক সময়ে দাম কমাতেও হবে।’
বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় দেশেও মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্যসচিবের সঙ্গে মিলমালিকেরা বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন’ এক বিজ্ঞপ্তিতে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। তাদের ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এখন থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হবে ১৯৮ টাকায়, যার বর্তমান দাম ১৬০ টাকা। আর ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা, যেটি বর্তমানে ৭৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা এবং খোলা পাম তেল প্রতি লিটার ১৭২ টাকায় বিক্রি হবে।
রোজার আগে ভোজ্যতেল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে দুই দফা মূল্য সংযোজন কর কমায় সরকার। এর পর গত ২০ মার্চ সরকার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা কমিয়ে ১৩৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৬৮ টাকা। ২০২১ সালের অক্টোবরে যা ছিল ১৬০ টাকা। একই বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ১৫৩ এবং মে মাসে দাম ছিল ১৪১ টাকা। বর্তমানে এ তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৮ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে (মে, ২০২১-মে, ২০২২) প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ৫৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
দাম বাড়ার পরও বাজারে সয়াবিনের বোতল উধাও। খোলা সয়াবিনও বিক্রি হচ্ছে অতিরিক্ত দামে। এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কী পদক্ষেপ রয়েছে জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক এ এইচএম সফিকুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে নতুন করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন আমরা বাজার তদারকি করে দেখব অতিরিক্ত মূল্য রাখা হচ্ছে কিনা। পাশাপাশি তেলের যে সংকটের অভিযোগ রয়েছে, সেটিও খতিয়ে দেখা হবে। এ লক্ষে আগামীকাল থেকে আমরা আবার তেলের বাজারে তদারকি শুরু করব।’