হাসছে মান্নান, কাঁদছে গাজীপুর!

Slider টপ নিউজ সম্পাদকীয়


গাজীপুরের ইতিহাসে যে কয়জন জনপ্রিয়ে নেতা ছিলেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক এম এ মান্নান অন্যতম। কারণ এই জেলার যারা জনপ্রিয়তার ইতিহাস গড়েছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক এম এ মান্নানই ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী পরিষদের প্রতিমন্ত্রী হন। গ্রাম সরকার থেকে ইউপি চেয়ারম্যান, এমপি প্রতিমন্ত্রী ও শেষে মেয়র হয়ে ইতিহাস গড়েছেন অধ্যাপক মান্নান। আর কুঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ভোটে ভাইসচেয়ারম্যান হওয়ার পর গাজীপুর সিটির মেয়র হন জাহাঙ্গীর আলম। এই দুই জনই গাজীপুর সিটির প্রথম ও দ্বিতীয় নির্বাচিত মেয়র।

পরবর্তি সময় বিরোধী দলের লোক হওয়ায় অধ্যাপক এম এ মান্নানকে চেয়ার থেকে গ্রেফতার করে কারাগারে নেয়া হয়। প্রায় তিন ডজন মামলা দিয়ে দফায় রিামন্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে। অধ্যাপক মান্নান যখন সিটিং মেয়র থেকে কারাগার-আদালত-পুলিশি হাজতে ঘুরছেন জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, তখন তার মেয়রের চেয়ারে বসার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। জনপ্রিয় অধ্যাপক এম এ মান্নান সাহেবের মুক্তির জন্য তার দল বিএনপিতে গাজীপুরে টু শব্দটিও হয়নি। কারণ বিএনপিতে দুটি গ্রুপ ৯০ এর দশক থেকেই সক্রিয় হয়ে এখনো স্বাস্থ্যবান অবস্থায় রয়েছে। ফলে বিএনপিতে মান্নান বিরোধী গ্রুপটি মান্নানের মেয়রের চেয়ার হারানোর প্রকল্পেও গোপনে গোপনে যোগ দেন। ফলে অধ্যাপক মান্নান মেয়রের চেয়ারে বসতে পেরেছিলেন অনেক কম সময়।

ইতিহাস বলছে,অধ্যাপক মান্নান মেয়রের চেয়ারে নিরাপদে থাকার জন্য সরকারী দলে এমনভাবে মিশে গিয়েছিলেন যে তার দল বিএনপির কোন কর্মসূচিতেও তেমনভাবে যেতেন না। বরং একাধিক মামলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা মাথায় নিয়ে টঙ্গির বিশ্ব ইজতেমার সভা পর্যন্ত করতে পেরেছিলেন তৎকালিন মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। গাজীপুর সিটির প্রথম ও প্রতিষ্ঠাতা মেয়রকে চেয়ার থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। চেয়ার হারিয়ে রিমান্ড ও জেলে থেকে অসুস্থ মান্নান আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তিনি আর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেননি। ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচন আসলে অধ্যাপক এম এ মান্নান অসুস্থতার কারণে দলীয় মনোনয়নও পাননি।

অধ্যাপক এম এ মান্নানের জানাজার নামাজে তার ছেলে প্রতিহিংসার রাজনীতি না করার বিষয়টি দেখভাল করতে জানাজায় উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ করেন। এতেই প্রমানিত হয় অধ্যাপক এম এ মান্নান প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার বলে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত। তবে অধ্যাপক এম এ মান্নানের জানাজার নামাজে বক্তাদের বক্তব্যে মানবিক রাজনীতির আবহ ছিল বলে মনে করলেও ভবিষৎ কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। আমাদের ইতিহাস যে শিক্ষা দেয় তাতে মানবিক রাজনীতির অধ্যায় খোঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ অধ্যাপক এম এ মান্নান গ্রেফতারের পর তিনি যে অভিশাপ দিয়েছেন তার ভিডিও বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, গাজীপুর সিটির দুইজন নির্বাচিত মেয়র চেয়ারে থাকতে পেরেছেন ৩ বছর করে ৬ বছরের মত। আর কাউন্সিলর হয়ে মেয়রের চেয়ারে আসাদুর রহমান কিরণ মোট ৪ বছর থাকছেন বলে আশা করা যায়। তাহলে নির্বাচিত মেয়রের চেয়ে কাউন্সিলর দিয়ে মেয়রের কাজ চলছে বেশী সময়।

সাধারণ মানুষ বলছেন, জানাজা থেকে মরণের কথা মনে করে কাজ করলে কোন অভিযোগ হালে পানি পাবে না। কারণ আজ জানাজায় দাঁড়িয়ে যেসব কথা বলছি, কাল আমার জানাজায় দাঁড়িয়ে এমনি কথা হবে, তাই অভিশাপ নিয়ে লাভ কি। যাকে মেয়র বানালে অভিশাপের ক্ষেত্র তৈরী হবে না, তাকেই মেয়র বানানো উচিত। তাহলে আর নির্বাচিত মেয়রকে চেয়ার হারা করিয়ে অভিশাপ নিতে হবে না।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যগাঁথা গাজীপুর জেলার প্রাণকেন্দ্রে গঠিত গাজীপুর সিটিকর্পোরশেনের দুটি নির্বাচনেই কোন নির্বাচিত মেয়র চেয়ারে থাকতে পারছেন না। একজন চেয়ার হারা হয়ে অবশেষে পরপারে চলে গেলেন। আরেক জন চেয়ার ফেরত পেতে কেঁদে কেঁদে ঘুরছেন। যেখানে ১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধ হয়েছে, সেই মাটি যদি ৪০ বছর অভিশাপ প্রাপ্ত হয়, তবে মহান মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুরের চেতনা নিয়ে আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম নানা ধরণের অভিযোগ করবে। আমরা কেন চেতনাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারিনি, এই অভিযোগে আমরাও অভিযুক্ত হতে পারি।

এমতাবস্থায়, গাজীপুরের জনপ্রিয় একজন নেতাকে আমরা ভোট দিয়েও চেয়ার থেকে অপমান করে নামিয়ে দিয়ে রিমান্ডে অত্যাচার করে জেলে রেখেছি। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি অসুস্থ অবস্থা থেকে আর ফিরে আসতে পারেননি। আমরা যে নজীর স্থাপন করেছি তার জন্য অধ্যাপক এম এ মান্নানের বর্নিল কর্মময় জীবন আমাদের প্রতিদানের পেয়ে হয়ত মুসচি হাসবে কিন্তু সারাজীবন কেঁদে যাবে গাজীপুরের মানুষ। সৃষ্টিকর্তা না করুক এমন অবস্থা যেন আর কারো না হয়।

গাজীপুরবাসী আশা করে, প্রথম স্বশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে সফলতার পুরস্কার হিসেবে গাজীপুরে ‍মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী উপহার দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন অবস্থায় এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সুতিকাগার গাজীপুর যদি অভিশাপপ্রাপ্ত হয়, তবে আগামী সময়ে এই জের অনেক ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দিবে না, এমন ধারণা অমূলক নয়। তাই আমাদের উচিত জানাজা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে সময়ে কাজ করা। তবেই আমাদের রাজনীতি অভিশাপমুক্ত হতে পারে। কারণ মানুষ ও ক্ষমতা দুটোই মরণশীল এবং এটাই বাস্তব্য ও সত্য।

লেখক
রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
তাং ০১/০৫/২২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *