ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন: রোজা ফ্রি র্যাডিকেল ইনজুরি কমিয়ে দেয়। প্রশ্ন হলো ফ্রি র্যাডিকেল ইনজুরি কাকে বলে? বেঁচে থাকার জন্য মানুষের শক্তি দরকার। আমাদের শরীরের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সেল থেকে অনবরত নানান রিয়েকশনের মাধ্যমে এই শক্তি উৎপাদিত হচ্ছে। কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিন থেকে আসা যথাক্রমে গ্লুকোজ, ফ্যাটি এসিড এবং এমাইনো এসিড মূলত অক্সিজেনের সাহায্যে ভেংগে কার্বন ডাইওক্সাইড, পানি ও কাজ করার এটিপি বা এনার্জি পাচ্ছি অবিরাম-অবিরত। কোষসমূহে চলা এই সমস্ত ক্যামিকেল রিয়েকশনের সময় অক্সিজেন পুরোপুরিভাবে নয় বরং আংশিকভাবে জারিত হয়ে অনাকাক্সিক্ষতভাবে বাই-প্রডাক্ট হিসেবে যে প্রডাক্ট বের হয়ে আসে তাকেই রিয়েক্টিভ অক্সিজেন স্পেসিস বলে।
এদের মাধ্যমে শরীরে যে ড্যামেজ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় তাকেই ফ্রি র্যাডিকাল ইনজুরি বলে। আর যারা এই ড্যামেজ প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহন করে তাদেরকে এক কথায় ক্ষতিকর অক্সিডেন্টও বলে। এই সমস্ত রিয়েক্টিভ অক্সিডেন্ট স্পেসিস কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ও নিউক্লিক এসিড সমৃদ্ধ উপাদানগুলোতে ক্রিয়া-বিক্রিয়া চলাকালীন সময়ে হয়ে থাকে। যেন ড্যামেজ করতে না পারে সে জন্য শরীর নিজ থেকেই এক ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলে যাদেরকে বলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ফ্রি র্যাডিকেল স্পেসিস ফর্মেশনের রিয়েকশনগুলো সংঘটিত হয় সেল সাইটোপ্লাজম, সাইটোপ্লাজমে থাকা মাইটোকন্ড্রিয়া, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম, পার অক্সিজম ও প্লাজমা মেমব্রেনে।
ধ্বংসকারী ফ্রি র্যাডিকেলের মধ্যে অন্যতম হলো সুপার অক্সাইড অক্সিজেন, সুপার অক্সাইড নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এবং হাইড্রক্সিল ইত্যাদি। আবার ধ্বংস প্রতিরোধে এগিয়ে আসা কয়েকটি উপাদান হলো সুপার অক্সাইড ডিসমিউটেজ (এসওডি), গ্লুটাথিয়ন পারঅক্সিডেজ, ভিটামিন-সি, ফেরিটিন, ক্যাটালেজ, সেরুলোপ্লাজমিন ইত্যাদি। যখন ধ্বংসকারী উপাদান ফ্রি র্যাডিকালসগুলো, ধ্বংসযজ্ঞে বাধা দানকারী অন্য উপাদান এন্টিঅক্সিডেন্টগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে কোষ গুলোর বিভিন্ন উপাদানকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়, ফলে এই দুই শক্তির মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়, তখন একে অক্সিডেটিভ স্ট্রেজ বলে। ফ্রি র্যাডিকেল ফর্মেশন বিক্রিয়া বেশি হয় ইনফ্লামেশন, রেডিয়েশন, অক্সিজেন টক্সিসিটি, ইনফেকশন, ক্যামিকেল রিয়েকশন কিংবা কোথাও কোন কোষে অক্সিজেন পৌঁছতে সমস্যার সৃষ্টি হলে। ফ্রি রেডিক্যালগুলো আসলে কী? আমরা জানি, প্রত্যেকটি পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হলো পরমাণু। এই পরমাণু গঠিত হয় ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে যার কেন্দ্রে জড়াজড়ি করে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন আর কেন্দ্রের বাইরে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরতে থাকে বিভিন্ন সংখ্যক ইলেক্ট্রন। আসলে ক্যামিকেল রিয়েকশন বলতে বাইরে কক্ষ পথে ঘুরতে থাকা ইলেক্ট্রনের যোগ-বিয়োগকে বুঝায়। সুতরাং ফ্রি র্যাডিকেল হলো এমন এক ধরনের ক্যামিক্যাল স্পেসিস যাদের সর্ব বাইরের কক্ষ পথে বিজোড় সংখ্যক ইলেক্ট্রন থাকে, যা খুবই অস্থির, ক্ষণস্থায়ী ও আনপ্রেডিক্টেবল।
এই অস্থায়ী ইলেক্ট্রনগুলো জোড়ার অভাবে সর্বদাই রিয়েক্টিভ অবস্থায় থাকতে চায়, ফলে বারবার অনাকাক্সিক্ষত রিয়েকশন হয়ে নতুন নতুন রিয়েক্টিভ অক্সিজেন স্পেসিস তৈরি হতে থাকে আর ফলস্বরূপ কোষের মধ্যে থাকা প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাট উপাদানগুলো আঘাত প্রাপ্ত হতে থাকে। ক্ষতিকর এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে ন্যাচারালি শরীরে প্রস্তুত থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো আনপ্রেডিক্টেবল অক্সিজেন স্পেসিসগুলোকে নানান রকম রিয়েকশনের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। এই নিষ্ক্রিয় করে ফেলার কাজ যত বেশি হবে তত বেশি আমরা ফ্রি র্যাডিকেল ইনজুরির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারব।
অক্সিডাইজড পদার্থগুলোর যত সব পাগলামী কাণ্ডকারখানা : যখন একটি পদার্থ ‘অক্সিডাইজড’ হয়, তার মানে তার কক্ষপথের ইলেকট্রন হারিয়ে বিজোড় এবং তার জোড়া খোঁজার জন্য অস্থির হয়ে আছে। অ্যান্টি অক্সিডেন্টগুলো এই অস্থির ইলেক্ট্রনগুলোকে নতুন ইলেক্ট্রন দান করে তাকে নিউট্রাল করে আমাদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। যদি অক্সিডাইজড এই পদার্থগুলোর বিজোড় ইলেক্ট্রনগুলোকে কেউ গ্রহণ না করে তখন এরা ভালো একটি পদার্থের ইলেক্ট্রন খশে নিয়ে নিজদের বিজোড় অবস্থা থেকে জোড় ইলেক্ট্রন হয়ে সুস্থির হয়ে তবে ক্ষান্ত হয়। কিন্তু এতে আরেকটি ভালো পদার্থে রিয়েকটিভ অক্সিজেন তৈরি হয়ে অক্সিডাইজড করে আমাদেরও ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেয়। এমতাবস্থায় ত্রাণ উদ্ধারকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় অ্যান্টি অক্সিডেন্টগুলো। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকলে সে অক্সিডাইজড পদার্থকে ইলেট্রন দান করে শরীরের অন্য প্রয়োজনীয় সেলগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
তাই অক্সিডাইজিং এজেন্টকে ইলেকট্রন গ্রহণকারী বলা হয়, কারণ তারা একটি পদার্থ থেকে ইলেকট্রন অপসারণ করে, তাদের ক্ষতির অবস্থায় ফেলে বা অক্সিডাইজ করে। আর অ্যান্টি অক্সিডেন্টগুলোকে ইলেক্ট্রন দাতা বলা হয়। প্রকৃতিতেও দাতা গ্রহীতার চরিত্র লক্ষণীয়। অক্সিডাইজড্ পদার্থগুলো অস্থির থাকে দান নিয়ে শান্ত থাকার জন্য নইলে ভালো আরেকজনকে আক্রান্ত করে তাকেও ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেয়। আর এন্টি অক্সিডেন্টগুলো ইলেক্ট্রন দান করে অস্থির অক্সিডাইজড পদার্থগুলোকে নিউট্রাল করে এবং শরীরের অন্যান্য ভালো সেলগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
ফ্রি র্যাডিকেল স্পেসিস কখন উৎপাদিত হয়? ফ্রি র্যাডিকেল এবং অন্যান্য রিয়েকটিভ অক্সিজেন স্পেসিস মানবদেহে স্বাভাবিক প্রয়োজনীয় বিপাকীয় প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে, এক্স-রে, ওজোন, ধূমপান, অত্যন্ত মানসিক ও শারীরিক চাপে থাকা ব্যক্তির শরীরে, বায়ু দূষণকারী এবং শিল্প রাসায়নিকের এক্সপোজারের মতো বাহ্যিক উৎসের উত্তেজকের ভূমিকার কারণে তৈরি হতে থাকে। এ ছাড়া উদ্বেগের সাথেই বলতে হচ্ছে চিনি জাতীয় খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ব্যাকিং, ডিপ ফ্রাইং ফুড, টিনজাত খাবার, ট্রান্সফ্যাট, মদ্যপান, মিষ্টি আচার, চকোলেট, চিপস, বিস্কিট এবং কেবল সুস্বাদু ও স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ডালডা, পার্শিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড খাবার ইত্যাদি মানবসৃষ্ট পুষ্টিহীন খাবার ফ্রি র্যাডিকাল ইনজুরি তৈরি করার ভাগাড়। ১৮৮২ সালে জার্মান জীববিজ্ঞানী ডক্টর অগাস্ট উইসম্যানের দ্বারা বার্ধক্যের কারণ হিসেবে ওয়ার ও টিয়ার তত্ত্ব নামে একটি তত্ত্বের প্রস্তাবনায় বলা হয় যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস, এক্সপোজারের মাধ্যমে শরীরের কোষ এবং টিস্যুগুলোর ধীরে ধীরে অবনতির ফলে বার্ধক্য হয়। বিকিরণ, বিষাক্ত পদার্থ বা অন্যান্য ক্ষয়কারী প্রক্রিয়াগুলোও এর জন্য কম দায়ী নয়।
এখানে রোজার ভূমিকা হলো রিয়েক্টিভ অক্সিজেন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে এবং এন্টি অক্সিডেন্ট কার্যক্রম জোরদার করে মানুষকে ফ্রি র্যাডিকেল ইনজুরির হাত থেকে রক্ষা করে। কিভাবে রোজা ফ্রি র্যাডিকেল ইনজুরির এই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে তা পরবর্তী পর্যায়ে তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।