রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় সহিংসতার ঘটনায় যারা অস্ত্রসহ হামলার অগ্রভাগে ছিলেন, তারা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের চার নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানতে পেরেছে, তারা সবাই কলেজের হলে ছিলেন এবং সেখান থেকে এসেই হামলায় অংশ নিয়েছিলেন।
গতকাল রবিবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারজনকে আটক করেছেন। তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। কিভাবে হামলা হয়, কারা কিভাবে ঘটনাস্থলে যান, হামলাকারীদের কারা ঘটনাস্থলে আনেন, কারা লাঠিসোটা ও অস্ত্র নিয়ে যেতে বলেছিলেনÑ এসব ব্যাপারে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-পুলিশের একাধিক টিম দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযানে নেমেছে। গতকাল সন্ধ্যায় র্যাবের একটি দল অভিযান চালায় ঢাকা কলেজের একাধিক হলে। সেখান থেকে জহির হাসান জুয়েল নামের এক শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। তিনি ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সর্বশেষ আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মঙ্গলবার অস্ত্র হাতে হামলায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। তারা ওই কলেজের হল থেকে বেরিয়েই হামলায় অংশ নেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজেও এ ধরনের দৃশ্য মিলেছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সুব্রত হালদার বাপ্পী, কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সামাদ আজাদ জুলফিকার, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জসিমউদ্দীন ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ফিরোজ হোসেন রাব্বীর অনুসারী। এদের মধ্যে বাংলা বিভাগের ছাত্র ইমন কুরিয়ার কর্মচারী নাহিদকে আঘাত করেন। ইমনের মাথায় ছিল কালো হেলমেট, পরনে ছিল ধূসর টি-শার্ট। তিনি এখন গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন বলে র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ইমন জুলফিকারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, শনাক্ত হওয়া আসামিরা শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা কলেজের হলে অবস্থান করলেও গ্রেপ্তার এড়াতে রাতেই গা ঢাকা দেন। সেই রাতেই একসঙ্গে অধিকাংশের ফোন বন্ধ হয়ে যায়। চিহ্নিত আসামিদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শনিবার রাতে উত্তরবঙ্গ থেকে একজনকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে আসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সংস্থা। রাতে ঢাকা কলেজের আন্তর্জাতিক হলে অভিযান চালিয়ে এক ছাত্রকে আটক করেছে র্যাব।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা কলেজের ছাত্র ও নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত নাহিদ মিয়া ও মোরসালিনের খুনিরা চিহ্নিত হওয়ার পর গ্রেপ্তারে অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চিহ্নিত কয়েকজন হলে অবস্থান করছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল রবিবার ঢাকা কলেজের একটি হলে অভিযানও চালানো হয়।
এদিকে নাহিদকে কোপানোর একটি ছবি ভাইরাল হওয়ার পর গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয় হামলাকারী যুবকের নাম রাব্বী। তিনি ঢাকা কলেজের নর্থ হলের মাস্টার্সের ছাত্র। তবে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, গণমাধ্যমে নাম এলেও তদন্তে দেখা গেছে, ঘটনার সময় রাব্বী দিনাজপুরে ছিলেন। এ ছাড়া নাহিদের ওপর হামলা চালানো সবার পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে অভিযান ও আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ জড়িতদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’
আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নাহিদকে কোপানোর ঘটনায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিরাজমান চারটি শক্তিশালী বলয়ের নেতাকর্মীরা অংশ নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি নেই। ফলে বিভিন্ন বলয়ের নেতাদের অধীনেই রাজনীতি করেন নেতাকর্মীরা। নাহিদের ওপর হামলায় চারটি গ্রুপের অনেকেই অংশ নেন।
প্রতক্ষ্যদর্শীরা বলছেন, ঢাকা কলেজের প্রধান ফটকের বিপরীতে নূরজাহান মার্কেটের সামনে আহত হন নাহিদ। প্রথম দিকে ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে তারা কলেজের ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর ছাত্ররা সংগঠিত হয়ে পাল্টা ধাওয়া দিলে পিছিয়ে আসার সময় নূরজাহান মার্কেটের গেটের সামনে পা পিছলে পড়ে যান নাহিদ। তখনই ছাত্রদের মাঝে কয়েকজন ছুটে এসে ধারালো অস্ত্র, রড, লাঠি, ইট দিয়ে নাহিদকে বেধড়ক আঘাত করতে শুরু করেন। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে নাহিদ নিস্তেজ হয়ে যান। তাকে পিটিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ছোরা হাতে কালো হেলমেট পরা একজন নাহিদকে কোপাতে থাকেন।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় নাহিদকে প্রথম মারধর শুরু করে কাইয়ুম ও সুজন ইসলাম নামের দুই ছাত্রলীগকর্মী। নীল রঙের মাঝে সাদা চেকের টি-শার্ট পরে সংঘর্ষে অংশ নেন কাইয়ুম। তিনি নাহিদকে রড দিয়ে আঘাত করেন। আর হলুদ হেলমেট ও লাল গেঞ্জি পরা সুজন ইসলাম নাহিদকে ইটের আঘাত ও লাথি মেরে আহত করেন। পরে ইমন নাহিদকে কোপানো শুরু করলে সুজন তাকে চড় মেরে সরিয়ে দেন। সুজন ঢাকা কলেজের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা। তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। নাহিদকে কোপানোর সময় পাশেই রামদা ও হাতুড়ি হাতে দেখা যায় ঢাকা ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাদিক মির্জাকে। সাদিকের গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলায়। জুলফিকারের অনুসারী। হাতুড়ি হাতে দেখা যাওয়া কাওসারের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। শুভ্রদেব বাপ্পির বলয়ে রাজনীতি করেন তিনি। রামদা হাতে থাকা মোনায়েম কলেজ ছাত্রলীগ নেতা জসীম উদ্দিনের অনুসারী।