প্রতীক ওমর (ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি): রমজান মানেই মুসলমানদের উৎসবের মাস। এই মাসকে উদযাপন করতে শাবান মাস থেকেই নানা আয়োজন চলে ঘরে ঘরে। বিশেষ করে ইফতারের স্বাদ নিতে বিভিন্ন জাতের খাবার অগ্রিম প্রস্তুত করে রাখে। প্রস্তুতির এই আয়োজনে নারীদের সরব দেখা যায়। বাংলাদেশী মুসলমানদের চিরচারিত ঐতিহ্য এটি। রমজানের নানামুখি আয়োজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইফতার মাহফিল। শহর নগর গ্রামগঞ্জে ইফতার মাহফিল চলে পুরো রমজান মাসজুড়ে। সাধ্য অনুযায়ী ছোট বড় আকাড়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এই আয়োজনটি।
একেকদিন একেক বাড়িতে চলে ইফতার মাহফিল। পুরো গ্রামের মানুষ বিকেল থেকে জড়ো হতে থাকে আয়োজকদের বাড়িতে। যুবকরা স্বেচ্ছায় রান্নার কাজে নিয়োজিত হয়। খাবার পরিবেশনসহ সব ধরণের কাজে তরুণদের অংশগ্রহণ দেখা যায়। গ্রামের এমন দৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে। শহরে অবশ্য রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে রেডিমেট সব কিছু পাওয়া যায়। রেডিমেট ভাবেই হয়ে থাকে শহুরে ইফতার মাহফিল।
রোজা রমজান সব ঠিক আছে। রোজাদারও নিয়মমত রোজা রাখছেন। কিন্তু এবারের রোজায় চোখে পড়ছে না বাংলাদেশী মুসলমানদের সংস্কৃতি ইফতার মাহফিল। উত্তরের জেলাগুলোর প্রত্যন্তগ্রাম এবং শহরগুলোর একই চিত্র চোখে পড়েছে। ইফতার মাহফিল কমেছে। পরিসর সিমিত হয়েছে। রেস্টুরেন্টগুলোতেও ইফতার পার্টি তেমন হচ্ছে না। কমিউনিটি সেন্টারগুলোর সিডিউল ফাঁকা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মানুষের আয় কমে যাওয়ার ফলে এবার ইফতার মাহফিল কম হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। কথা হয় গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার শাহাবাজেরপাড়ার জাহিদুল ইসলামের সাথে। তিনি মানবজমিনকে জানান, রমজানে প্রতিবার গ্রামে তিনি ইফতার মাহফিল করেন। প্রতিবছরের ধারাবাহিক ঐতিহ্য এটি। এবারও তিনি আয়োজন করবেন। কিন্তু মানুষের পরিমাণ হয়তো কম হবে। বাজারের প্রত্যেক পণ্যের দাম নাগালের বাইরে। গত বছরের রমজানে গরুর গোস্ত কিনেছিলাম ৪৮০টাকা কেজি। সয়াবিন তেল ৯০/১০০ টাকা কেজি ছিলো। চাল ডাল সবজিও কমছিলো। বর্তমানে গরুর গোস্ত ৬৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তেলে, সবজির দামও চড়া। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বেশি মানুষকে দাওয়াত করতে পারবো না।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়ধানগড়া এলাকার রানা আহমেদ জানান, প্রতিবছর রমজানে তাদের গ্রামের দুটি বড় মসজিদ কেন্দ্রীক ইফতার মাহফিল হয়ে থাকে। গেলো বছর করোনার কারণে হয়নি। এবার অর্থনৈতিক মঙ্গার কারণে এখন পর্যন্ত ইফতার মাহফিলের উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করেনি। তিনি আরো বলেন, গ্রাম-গঞ্জের ইয়াতিমখানা মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীদের বরাবরেই সাধারণ মানুষ ইফতার দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে। এবারের রমজানে মাদ্রাসাগুলোও তেমন সহযোগিতা পাচ্ছে না। ফলে ইয়াতিম শিক্ষার্থীরা ভালো খাবার থেকে এবার কিছুটা বঞ্চিত হচ্ছে।
সাদুল্লাপুর উপজেলার ছোট গয়েশপুর বাবরি জামে মসজিদ কমিটির উপদেষ্টা মির্জা নূরুন্নবী বলেন, রমজানে আমাদের গ্রামের মানুষ প্রতিদিন এই মসজিদে ইফতার করতো। একেক দিন একেক জন খাবার দিতো। কোন কোন দিন কয়েকজন মিলে দিতো। কিন্তু এবার রমজানে ছয়/সাত দিন ইফতার মাহফিল হবে কিনা সন্দেহ আছে। তিনিও মনে করেন, বাজারপরিস্থিতি খারাপের কারণে ইফতারের আয়োজন করতে মানুষ সাহস পাচ্ছে না।
এদিকে আয় কমে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গেলো বছর করোনায় অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। কম বেশি প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাটাই করা হয়েছে। ফলে বেকারের তালিকাও লম্বা হয়েছে আগের বছরের চেয়ে।
রাজশাহী প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. আসলাম উদ দৌলা বলেন, বর্তমান দেশে মুদ্রাস্ফীতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষের আয়ের তুলনায় বাজারমূল্য অনেক বেশি। ফলে সংসারের হিসাব মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে এবারের রোজায় ইফতার মাহফিলের আয়োজন একেবারেই কমেছে। তিনি মনে করেন, ইফতার মাহফিলগুলোর বেশির ভাগ অংশগ্রহণ করেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এই শ্রেণির মানুষ এখন চরম বিপাকে আছে। এবারে ইফতার মাহফিল কম হওয়ার পিছনে এটি একটি বড় কারণ। ইফতার মাহফিল আয়োজনের যে প্রতিযোগিতা ছিলো সেই প্রতিযোগিতাও এবারে একেবারেই চোখে পড়ছে না।
উত্তরজনপদের সাধারণ মানুষের আয় একেবারেই সিমিত। কোন রকম সংসার চলার মত আয় করেন বেশির ভাগ মানুষ। ভারি শিল্প কারখানা না থাকায় অতিরিক্তি আয় নেই এই অঞ্চলের মানুষদের। কৃষির উপর নির্ভরশীল এঅঞ্চল। তারপরেও রোজায় মানুষ মাসব্যাপি উৎসব করতো। এবার পুরোটাই ভিন্ন পরিস্থির রোজা। হাজারো চিন্তা মাথায় নিয়ে মানুষ দিন কাটাচ্ছে। একাকি নিভৃতে পালন করছে রমজানের ইবাদত। পকেট ফাঁকা থাকায় মানুষ এবার ইফতার মাহফিলের আয়োজন থেকে বিরত থাকছেন।
বগুড়ার অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক সংগঠন ফেসবুক ফেন্ডস সোসাইটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মনে করেন, সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর ব্যানারে প্রচুর ইফতার মাহফিল চোখে পড়তো। প্রতিদিন এক দুইটি ইফতার মাহফিলের দাওয়াত আসতো। এবার খুব কম লক্ষ্য করছি। মানুষের মধ্যে এক ধরণের হতাশা বিরাজ করছে। টালমাল পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। ফলে ইফতার মাহফিলে মন নেই কারো।
এদিকে শহরের আভিজাত হোটেল, রেস্তোরা, কমিউটিনি সেন্টারগুলোও অলস সময় কাটাচ্ছে। ইফতারের সময় সাধারণ মানুষ এককভাবে অথবা পারিবারিকভাবে হোটেল, রেস্তোরাগুলোতে গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক অথবা সাংগঠনিক ইফতার মাহফি হচ্ছে না বলেই চলে।
বগুড়া শহরের স্কাউ ভিউ রেস্টুরেন্টের পরিচালক সৈয়দ সোহেল আহম্মেদ লিটন বলেন গেলো ৯ রমজানে মাত্র একটি ইফতার পার্টি হয়েছে তার রেস্টুরেন্টে। করোনার আগের বছরগুলোতে যেখানে প্রতিদিন ইফতার পার্টি হতো। তার আশেপাশের কমিউনিটি সেন্টারগুলোতেও ইফতার পার্টি চোখে পাড়েনি। তিনি মনে করেন, করোনায় অর্থনৈতিকভাবে জর্জরিত মানুষ নিজেদের গোছাতে ব্যস্ত। বেশিরভাগ মানুষের পকেটে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। ফলে ইফতার পার্টিতে এর প্রভাব পড়েছে।
বগুড়ার আরেক আভিজাত রেস্টুরেন্ট ‘পদ্মা ফুডস’র পরিচালাক এমদাদ আহমেদ বাবু বলেন, এবারের রমজানে তার রেস্টুরেন্ট ফাঁকা পড়ে থাকছে। পারিবারিক এবং সাধারণ গ্রাহক দিয়েই ইফতারের আয়োজন চলছে। এখন পর্যন্ত কোন পার্টি তার রেস্টুরেন্টে হয়নি। আগামী দিনগুলোতে হবে কি না বা কি পরিমাণ হবে আন্দাজ করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে মানুষ অভাবে আছে এটি স্পষ্ট।
এদিকে ইফতার মাহফিল কম হলেও কিছু ব্যক্তি, সংগঠন কম সৌভাগ্যবানদের মাঝে খাদ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন বগুড়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান আকন্দ। তিনি রমজানের আগে থেকেই শহরের বিভিন্ন প্রান্তের প্রান্তিক জনগোষ্টির মাঝে খাদ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। এর আগের বছর রমজানে তিনি প্রতিদিন কয়েক হাজার রোজাদারকে রান্না করা খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এবার তিনি খাদ্যের প্যাকেট দিচ্ছেন। এবারের রোজা এবং সাধারণ মানুষ কেমন আছে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানুষ ভালো নেই। রাষ্ট্র মানুষকে বাধ্য করেছে নিজেকে নিয়ে চিস্তায় ব্যস্ত থাকতে। আশেপাশের মানুষ কেমন আছে, কিভাবে আছে সেই ভাবনার সুযোগ নেই কারো। ব্যবসায়ীরা মূলত সামাজিক কার্যক্রমগুলোতে আর্থিক সহযোগিতা করে থাকেন। নেই ব্যবসায়ীরাও ভালো নেই। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী এখন হশাত হয়ে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। ঠিকাদাররা কাজ শেষ করেও বিল পাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে তারা অন্যের সমস্যায় এগিয়ে আসবে?
আব্দুল মান্নান আরো বলেন, বাজারের চাল, ডালসহ বিভিন্ন পন্যের দাম কমতে শুরু করেছে। কিছু দিনের মধ্যেই বাজারে নতুন চাল আসবে। ফলে দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে চালের আড়ৎদাররা আটকে রাখা চাল এখন বাজারে ছাড়তে শুরু করেছে। ফলে স্বংক্রিয়ভাবেই চালের দাম কিছুটা কমেছে। আর সবজির দাম সরকারের হাতে থাকে না। অনেকটা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। কিন্তু সোয়াবিন তেলের দাম পুরোটাই সরকারে হাতে। সরকার সেখানে দাম কমায়নি। সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি আশাকরে বাজার মূল্য সহনশীল রাখার।
বৈশ্যিক পরিস্থিতি সামলে উঠতে সাধারণ মানুষ এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। ক্ষয়ে যাওয়া পুঁজি পুনরুদ্ধার করতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে। খেটে খাওয়া দীনমজুর থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যায় পর্যন্ত একই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। অনেকটা এলোমেলো হয়ে পড়েছে মানুষ। সামাজিক কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে। দানের উপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানগুলো পথে বসার উপক্রম। ফলে রোজার আমেজ কিছুটা থমকে গেছে। তবে রোজার শেষ দশকের দিকে কৃষকের ঘরে আগামজাতের ধান উঠবে। তখন হয়তো চলমান পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে। ইফতার মাহফিলে জমে উঠতে পারে গ্রামগুলো।