শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থার গতি-প্রকৃতি তুলে ধরে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত ২০শে মার্চ ঢাকা-ওয়াশিংটন অংশীদারি সংলাপে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বদানকারী স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টানেন। তখনো শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দৈন্য-দশার বিষয়টি পাবলিক ডোমেইনে এতোটা খোলাসা হয়ে আসেনি। বন্ধু এবং উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের বলেন, চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা খাতির বাড়ানোর আগে ভাবা উচিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার অথনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, চীনের কাছ থেকে তারা অর্থনৈতিক সহযোগিতা পেয়েছিল। কিন্তু ‘অবিবেচনামূলক’ ঋণ তাদের বিপদ বাড়িয়েছে। শ্রীলঙ্কা আজ ঋণের ফাঁদে পড়ে হিমশিম খাচ্ছে! সরকারি সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বন্ধু রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীদের তরফে আগাম সতর্কবার্তা পেয়ে ঢাকার নীতি নির্ধারকরাও নড়েচড়ে বসেছিলেন।
যার প্রতিফলন রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে। বাংলাদেশে আগাগোড়ায় বিদেশী ঋণের বিষয়ে সতর্ক রয়েছে বলে দাবি করেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা।
উল্লেখ্য, বিপুল ঋণের বোঝায় বেসামাল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। বিশ্লেষকদের মতে, কলম্বোর অবস্থা অনেকটা ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো। তারা ‘অহেতুক’ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে শো-অফ করছিল, আর মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘বন্ধু’ চীনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল! মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্ব এবং খাদ্য থেকে ওষুধ- নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের ঘাটতি আজ জাতি হিসেবে শ্রীলঙ্কানদের কঠিন এক সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জ্বালানি সংকট, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতিসহ হেন সংকট নেই যা এখন লঙ্কাতে অবশিষ্ট আছে। কাগজ আমদানি করতে না পারায় দেশটিতে স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা পর্যন্ত বাতিল হয়েছে! সব মিলিয়ে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এবারই প্রথম শ্রীলঙ্কায় এতোটা প্রকট হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। দেশটিতে খাদ্যের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া। এ অবস্থায় ‘বন্ধ’ু চীন তাদের ফেলে যায়নি। তবে দুর্দিনে যতটা এগিয়ে আসা কাঙ্খিত ছিল তা দেখা যায়নি। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ঢাকা-ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক আলাপে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার প্রকল্প ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে (আইপিএস) বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ কামনা করা হয়। আইপিএস-এ আকর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্যাকেজ থাকছে জানিয়ে ঢাকাকে এর পূর্ণ সুবিধা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায় যুক্তরাষ্ট্র। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিকে (আইপিএস) সম্ভাবনাময় উল্লেখ শিগগির এর ‘ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক’ প্রকাশ হবে বলে জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন সংকটে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই: এদিকে ইউক্রেন আক্রমণকে রাশিয়ার একতরফা আগ্রাসন উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গৃহীত অবস্থান পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছে। যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার জন্য রাশিয়ার নিন্দা করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত একটি প্রস্তাবের ওপর ভোটদান থেকে বাংলাদেশ বিরত ছিল। ২রা মার্চের ওই ভোটে অ্যাবস্টেইন করার (ভোটাভুটিকালে উপস্থিত থাকলেও ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটদানে বিরত) মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নিজের নিরপেক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে বলে তখন ঢাকার তরফে দাবি করা হয়। ২০শে মার্চ ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারি সংলাপে বাংলাদেশের সেই ‘নিরপেক্ষ অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে যুক্তরাষ্ট্র। অনুষ্ঠানে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, ইউক্রেন সংকট বিশ্বকে এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যে, এতে নিরপেক্ষ থাকার কোন অবকাশ নেই। তাছাড়া এটা নিরপেক্ষ থাকার সময় নয়। মার্কিন প্রতিনিধি ইউক্রেন পরিস্থিতির মূল্যায়নে বলেন, এটা স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মধ্যকার কৌশলগত প্রতিযোগিতার নমুনা। এই পরিস্থিতি বৈশ্বিক সমৃদ্ধি আর বৃহত্তর নিরাপত্তায় একটি অস্বস্তিকর অবস্থার তৈরি করেছে, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে অ্যাবস্টেইন বা ভোট দানে বিরত থাকার প্রসঙ্গ টেনে মার্কিন প্রতিনিধিরা বলেন, বাংলাদেশ সর্বাবস্থায় গণতন্ত্রের পক্ষে থাকবে- এটাই প্রত্যাশিত। সেই বৈঠকের চারদিনের মাথায় জাতিসংঘে উত্থাপিত আরেকটি প্রস্তাবে (যাতে ইউক্রেনে মানবিক সহায়তার কথা বলা হয়েছে) নাটকীয়ভাবে ‘পক্ষে’ ভোট দেয় বাংলাদেশ। সেই সময়ে বাংলাদেশের অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ প্রভাব ফেলেছে বলে অনেকেই মনে করছিলেন। কিন্তু তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ফের জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে (৭ই এপ্রিল ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার সংক্রান্ত রেজ্যুলেশন) বাংলাদেশের অবস্থানে পরিবর্তন ঘটলো। এবারও ভোটদান থেকে বিরত থাকলো বাংলাদেশ। যদিও ৯৩-২৪ ভোটে রাশিয়াকে বহিষ্কার সংক্রান্ত বহুল আলোচিত রেজ্যুলেশনটি পাস হয়েছে।