ফরহাদ হোসেন। হোটেল ব্যবসায়ী। করোনার পর থেকে তার ব্যবসা যাচ্ছে মন্দা। কোনোভাবেই লাভের মুখ দেখছেন না। অথচ খরচ বেড়েছে। খরচ সামলাতে না পেরে বেশ কয়েকজন কর্মচারীকে ছাঁটাই করেছেন। গত দুই বছরে ঋণ করেছেন সাড়ে ৬ লাখ টাকা। তবুও ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশায় আছেন তিনি। কিন্তু প্রতিটা দিন ফরহাদের কাছে অসহ্য যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফরহাদ বলেন, এখন আমরা এমন একটা সংকটে আছি যা বলার ভাষা নেই। ব্যবসা তো নেই, পরিবার চালাতেও করুণ অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতেও বাজার খরচ বাড়াননি ফরহাদ। এখনো মাসে ১০ হাজার টাকা দিয়েই খরচ চালান। তবে কাটছাঁট করেছেন খাদ্য তালিকা। আগে যেখানে মাসে পাঁচ লিটার তেলে রান্না করতেন এখন তা নামিয়ে তিনে এনেছেন। গরুর মাংস বাদ দিয়ে মুরগির মাংস কিনেন। তাও মাসে দুইবারের বেশি না। ভিটামিনের অভাব পূরণে ফলমূল খাওয়া প্রায় বাদ দিয়েছেন বললেই চলে। ফরহাদ বলেন, এক বছর আগেও সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১০০ টাকা। কিন্তু এখন সরকার দাম কমানোর পরও তেল ১৬০ টাকা করে নেয়। এক বছরে যদি ৬০ টাকা শুধু তেলের দামেই বাড়ে তাহলে কীভাবে কিনে খাবো।
স্ত্রী ও এক মেয়ে নিয়ে ফরহাদের ছোট পরিবার। একমাত্র মেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন তার। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যেখানে সংসার চালানোই কঠিন সেখানে মেয়েকে ডাক্তার বানানোটা দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি। ফরহাদ বলেন, এখন যে অবস্থা আমার মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়ানোও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার লেখাপড়ার জন্যই আমাকে মাসে ১৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। এই খরচ চালাতেই পারছি না। তাই ডাক্তার বানানোর চিন্তাও করতে পারছি না। এ ছাড়া বাসা ভাড়া আর আনুষঙ্গিক খরচ তো আছেই। এসব নিয়ে খুবই কষ্টের মধ্যে আছি।
হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, নিত্যপণ্যের চড়া দামে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা অনেক কমেছে। একটা বিশাল অংশের মানুষ পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছেন না। এতে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। এতে শরীরে নানা ধরনের রোগ দেখা দেবে। সুস্থভাবে কাজ করার শর্ত হচ্ছে শরীরকে পুষ্টিকর খাবার দেয়া। কিন্তু সেটা ব্যাহত হচ্ছে। আবার জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে মানসিকভাবেও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এটাও তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে।
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জুনায়েদ ইকবাল। দুই বছর আগেও প্রতি সপ্তাহে তার খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংস ঠাঁই পেতো। তবে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করতে হয়েছে তাকেও। জুনায়েদ বলেন, কম বেতনের চাকরি করি। সন্তানের লেখাপড়া, সংসার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত জিনিসের দাম বাড়ছে। সরকারও ব্যবসায়ীদের মতো মানুষের কথা চিন্তা করছে না। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এদিকে বাসা-বাড়ির ভাড়া তো প্রতি বছরই বাড়ছে। কিন্তু আমার বেতন তো বাড়ছে না। গত পাঁচ বছর ধরে আমার কোনো বেতন বাড়েনি। খরচ বেড়েছে বহুগুণে। এক বছর আগেও ১৫ হাজার টাকায় যা করা যেত এখন তা করতে ২৫ হাজার টাকা লাগছে। খুব কষ্টে আছি।
ছোট একটি দোকানে দর্জির কাজ করেন জাকির হোসেন। আগে গার্মেন্টে কাজ করতেন। ভালো টাকা বেতন পেতেন। তখন ভালো মতোই সংসার চলতো। করোনা আসার পর থেকে তার চাকরি চলে যায়। লকডাউনে অনেক খোঁজখুঁজি করেও কোনো চাকরি পাননি। এরপর দর্জির দোকানে কাজ শুরু করেন। কিন্তু এতে তার আয় অতি সামান্য। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার বেশি আয় হয় না। নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যে তার এই উপার্জনে কিছুই হয় না বলে জানান জাকির। তাই স্ত্রী আর তিন মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবন চালাচ্ছেন তিনি। এর মধ্যেও আবার দুই মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। খরচ কমাতে তিনিও বাধ্য হয়েছেন খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করতে। জাকির বলেন, এখন সংসার চালাতে আমাদের কষ্ট হয়। কিন্তু কাকে কি বলবো। গরিবের কথায় কেউ গুরুত্ব দেয় না। আমরা এখন ভালো জিনিস খাইতে চাইলে পারি না। ডাল-ভাত খেতেই কষ্ট হয়। কোনোরকমে দিন যায়। ঘর ভাড়া ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। আমি প্রতিদিন ২০০ টাকা দেই সংসারের খরচ। এই টাকা দিয়ে তো মাছই কেনা যায় না। বাকি জিনিস কি দিয়ে কিনবো।
জাকির হোসেনের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস এসএসসি পরীক্ষার্থী। পড়ালেখায় বেশ মেধাবী। কিন্তু তাকে লেখাপড়ার জন্য কোনো সহযোগিতা করতে পারছেন না তিনি। যেখানে সংসার চালাতেই তার বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে সেখানে মেয়ের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করবেন কীভাবে? আর্তনাদের সঙ্গে এই করুণ কথাও তুলে ধরেন জাকির। বলেন, সংসার চলাতে হিমশিম খেতে হয়। বাচ্চারাও লেখাপড়া করে। আমি কি সংসার চালাবো নাকি বাচ্চাদের লেখাপড়া করাবো। মাস শেষে বাসা ভাড়া দিতে হলে মানুষের কাছে ধার করা লাগে। গরিবদের দিক তাকাইয়া সব কিছুর দাম কমানো উচিত।
কামাল পাশা ছোট একটি মুদি দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরিবারে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। দোকানের আয় আর খরচ মিলিয়ে সামান্য লাভের দেখা পান। তা দিয়েই কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তিনি। কামাল বলেন, বাজারের নিত্যপণ্যের দাম আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। খাওয়া দাওয়ায় অনেক কষ্ট হচ্ছে। পানির দাম বাড়ছে, গ্যাসের দাম বাড়ছে। বিদ্যুৎ বিল বাড়ছে। এই খরচ আমরা কীভাবে দিবো। আমার তো আয় বাড়েনি। বর্তমান বাজারে গরুর মাংস ৭০০ টাকা কেজি। আমাদের পক্ষে কি এত টাকা দিয়ে মাংস কিনে খাওয়া সম্ভব। এরসঙ্গে আরও অন্যান্য মশলা খরচ আছে। এখন আমরা চাইলেও বাজার থেকে মাংস কিনে খেতে পারি না।
সন্তানের মুখে খাবার দেয়ার জন্য গ্রামে পরিবার রেখে ঢাকায় এসেছেন শাহাদাত। রিকশার চাকা ঘুরলে ঘোরে তার সংসারের চাকা। প্রতিদিন রিকশা চালালে মাসে তার ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় হয়। এখান থেকে গ্রামে পরিবারের জন্য ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা পাঠাতেন। বাকিটা তার ঢাকায় মেস ভাড়া আর খাওয়ার খরচ। এতদিন কোনোভাবে সংসার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সংসারের টানাপড়েন বাড়ছে। আগে রিকশা চালিয়ে দিনের বেলা হোটেলে ভাত খেতেন। কিন্তু এখন কলা-রুটি খেয়েই টাকা সাশ্রয় করেন। শাহাদাত বলেন, এখন কষ্ট হয় বাবা, অনেক কষ্ট হয়। আমার ইনকাম দিয়া কোনোরকম ডাল-ভাত খাই। প্রতিদিন গাড়ি চালাতে হয়। একদিন চালাতে না পারলে দেনা করে চলতে হয়। পরে কাম করে শোধ করতে হয়।
সিএনজি চালক শাহিন মিয়া। আটজনের সংসার তাদের। শুধু বাবা আর তার উপার্জনেই সংসার চলে তাদের। সড়কে অতিরিক্ত জ্যামের কারণে তার আয় কমেছে। শাহিনের বাবার উপার্জনও খুব বেশি নয়। তিনি বলেন, দিন আনি দিন খাই। একদিন কাম করতে না পারলে খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে যাই। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পর থেকে খুব টানাটানির মধ্যে আছি। প্রতিদিন ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পাই। ঘর ভাড়ার জন্য টাকা আলাদা করে রাখি। বাকি টাকা বাজার খরচে দিতে হয়। কিন্তু তা দিয়ে কিছুই হয় না। মাছ-মাংস কিনে খাওয়া হয় না। ডাল, আলু ভর্তা আর শাক দিয়া কোনোরকম খেতে হয়। মাসে একবার মাংস কিনে খাইতেও কষ্ট হয়। কোনো মাসে খাইতেও পারি না। রান্নার জন্য তেল কিনতেও অনেক টাকা লাগে। তাও না কিনে পারা যায় না।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মেকানিক্যাল বিভাগে কাজ করেন বাবুল মণ্ডল। দ্রব্যমূল্যের ধাক্কায় তিনিও নাভিশ্বাস ফেলছেন। ঢাকায় নিজের একটি ছোট বাড়ি আছে তার। সেখানে মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান ও ভাই-বোন নিয়ে আটজন থাকেন। পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই। তাই তিনি একাই সংসার চালান। বাবুল বলেন, আমি সব মিলে ১৭ হাজার টাকা বেতন পাই। মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা শুধু নিত্যপণ্য কিনতেই চলে যায়। তাও আগের মতো বাজার করতে পারি না। পরিবার নিয়া সপ্তাহে একদিন ভালোমন্দ খাইতে পারি না। কম দামি শাক-সবজি দিয়েই খাই। সন্তানের লেখাপড়া, বাবা-মায়ের ওষুধ এসব খরচ আছেই। নিজের বাড়ি আছে। ঘরভাড়া লাগে না। এজন্য কোনোরকম চলতে পারি।
সাবান উৎপাদনকারী একটি ফ্যাক্টরিতে দিনভিত্তিক কাজ করেন আবুল হোসেন। দিনে আট ঘণ্টা কাজ করে তার মাসিক আয় ৭ হাজার ৫০০ টাকা। এই টাকায় সংসার চালানো অসম্ভব। তাই মাঝেমধ্যে রিকশা চালান তিনি। আবুল হোসেন বলেন, গ্রামে কাজ-কাম সেভাবে নেই। এজন্য ঢাকায় একটা সাবান তৈরির ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। দিনে ২৫০ টাকা আয় হয়। জিনিসের দাম বাড়ায় অনেক সমস্যার মধ্যে আছি। খাবার হোটেলে সবকিছুর দাম বেড়েছে। আগে দুইটা পরোটা ও সবজি খেতে ২০ টাকা লাগতো। এখন লাগছে ৩০ টাকা। একটা ডিম ভাজির দাম ছিল ১৫ টাকা এখন তা ২০ টাকা। ১০ টাকার ভাত খুবই অল্প দেয়া হয়। মাছ ও মাংস তো দামের জন্য খেতেই পারি না। যা টাকা আয় করি তার অনেকটা শেষ হয়ে যায় খাওয়া-দাওয়ায়। এজন্য গ্রামে তেমন টাকা পাঠাতে পারি না।
মামুন ওয়াহিদ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা দৈনন্দিন ব্যয় এবং শিক্ষাব্যয়ের সিংহভাগ নির্বাহ করি পরিবার থেকে। জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে পরিবারের ব্যয় বাড়ছে। খাতা-কলমের দাম বাড়ছে। তাই আমাদের লেখাপড়ার খরচ চালানো দুরূহ হয়ে যাচ্ছে। স্যারদের কাছে আলাদা পড়াতে পারছি না। তাছাড়া আমরা এখন আগের মতো পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছি না। নিরাপত্তাকর্মী আব্দুস সালামও জিনিসপত্রের দামে অতিষ্ঠ। মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। খরচ কমাতে খাদ্য তালিকায় বড় পরিবর্তন এনেছেন তিনিও। শুধু কোরবানির ঈদ ছাড়া মাংস কিনে খাওয়ার মতো অবস্থা নেই বলেও জানান তিনি। ডেমরা পুলিশ লাইন্স থানার পুলিশ সদস্য সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের চড়া দামে হিমশিম খাচ্ছি। আমরা সীমিত টাকা বেতন পাই। এই টাকা দিয়ে চলা যায় না। কষ্ট হয়। গ্রামে বাবা-মাকে টাকা দিতে পারি না। আগে জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। তখন দিতে পারতাম।
সড়কে যানজট বাড়ার কারণে আয় কমেছে গণপরিবহন চালকদের। অথচ দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে কোণঠাসা তারা। বাহন পরিবহনের বাস চালক রিপন মিয়া বলেন, সব কিছুর দামই বাড়ছে। আগে যেখানে এককেজি গরুর মাংস কিনতাম সেখানে এখন এককেজি মুরগির মাংস কিনে খাই। আমাদের তো খেয়ে চলতে হবে। যেখানে দুই কেজি ডাল দিয়ে মাস চলতো এখন এককেজি দিয়ে চালাতে হয়। ভাত তো আর কম খাওয়া যায় না। তাহলে তাও করা লাগতো। পাঠাও রাইডার জাকির হোসেন বলেন, আমি রঙের মিস্ত্রি। এখন কাম নেই। তাই পাঠাও চালাই। যে টাকা পাই তা দিয়ে খুব কষ্ট হয় চলতে। তাই বাজার থেকে দরকারি সব জিনিস কম করে কিনে কোনোরকমে চলছি।