গাজীপুর: বাংলাদেশে ১২টি সিটিকর্পোরেশনের মধ্যে গাজীপুর সিটিকর্পোরেশন ১১তম। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সিটিকর্পোরেশন গাজীপুর সিটিকর্পোরেশন। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটিকর্পোরেশনের প্রথম ও ২০১৮ সালে দ্বিতীয় নির্বাচন হয়। এই হিসেবে ২০২৩ সালে তৃতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আর তৃতীয় নির্বাচনের বাকী আছে মাত্র বছর খানেক।
বাস্তবতা বলছে, এই সিটিতে মেয়র পদে বসলেও মেয়াদ উত্তীর্ণ করা যাচ্ছে না। তিন বছরের মত সময় নির্বাচিত মেয়র চেয়ারে থাকতে পারছেন। দুই জন নির্বাচিত মেয়র চেয়ার হারা হওয়ার পর ভাগ্যবান ব্যাক্তি হিসেবে মেয়রের চেয়ারে বসছেন একজন কাউন্সিলরই। দুইজন নির্বাচিত মেয়রকে বিদায় করে একজন কাউন্সিলরই চেয়ারে বসে বাকী মেয়াদ পূরন করতে যাচ্ছেন। তবে এখন মেয়রই শুধু নয়, যারা মেয়র প্রার্থী হতে চায় তারাও নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক রোষানলে পড়া শুরু করেছেন। এ সকল মেয়র বা মেয়র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমান হওয়ার আগেই রাজপথের এ্যাকশন বলে দেয়, গাজীপুর সিটিমেয়রের নাম নিলেই খবর আছে। তাহলে সহজেই প্রশ্ন এসে যায়, কাকে মেয়র বানালে খবর থাকবে না। মেয়র নির্বাচনকে সামনে রেখে সেটা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। একই সাথে যেসকল মেয়র বা মেয়র প্রার্থীরা সরকারী দলের নেতা, তাদেরও পদ নিয়ে টানাটানি শুরু হতে পারে এমন আশংকাও বহমান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সালে তৎকালিন বিরোধী দলের হয়ে মেয়র হন অধ্যাপক এম এ মান্নান। তখন সরকারী দলের প্রার্থী এডভোকেট আজমত উল্লাহ খান পরাজিত হন। রাজনৈতিক মামলায় কারাবাসের কারণে অধ্যাপক মান্নান তিন বছরের মত চেয়ারে ছিলেন। তার চেয়ারে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে বাকী মেয়াদ চালান কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় নির্বাচনে সরকারী দলের প্রার্থী হিসেবে এডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচতি হন। বিরোধী দলের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকাকে পরাজিত করেন জাহাঙ্গীর আলম। মেয়র হওয়ার সময় জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এদিকে তিন বছরের মত দায়িত্ব পালন করে সাময়িক বরখাস্ত হন সরকারী দলের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিজ ঘরে বসে রাষ্ট্রদ্রোহীমূলক কথাবার্তা বলেছেন। পরবর্তি সময় ওই অডিও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে শুরু হয় আন্দোলন। সরকারী দলের লোকজন সরকারী দলের মেয়রকে সরানোর জন্য আন্দোলন করে রাজপথে। এক পর্যায়ে মেয়র ও দলীয় পদও হারান জাহাঙ্গীর আলম। বর্তমানে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। জাহাঙ্গীর আলমকে সরিয়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চেয়ারে বসেন আসাদুর রহমান কিরণ। গাজীপুর সিটির প্রথম ও দ্বিতীয় মেয়র যখন চেয়ার ছাড়া তখন দায়িত্ব পালন করেন কাউন্সিলর কিরণ। এতে নিঃসন্দেহে কিরন ভাগ্যবান। কারণ একবারও মেয়র নির্বাচন না করে দুই বার মেয়রের চেয়ারে বসার সৌভাগ্যবান ব্যাক্তি টঙ্গীর জনপ্রিয় কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ।
সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুর সিটিকর্পোরেশনের আসন্ন তৃতীয় নির্বাচনে মেয়র হওয়ার জন্য ইতোমধ্যে প্রচারণ-প্রচারণা শুরু হয়েছে। যারা সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন তাদের দুই জন মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধেও আগাম অভিযোগ উঠে গেছে। এই দুই জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের লোক। একজন কেন্দ্রীয় নেতা ও আরেকজন গাজীপুর মহানগর যুবলীগের নেতা। কিছু দিন আগে যুবলীগের নেতা ও মেয়র প্রার্থী সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগে জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ হয়। সরকারী দলের আরেকজন মেয়র প্রার্থী মামুন মন্ডলের বিরুদ্ধে টিসিবির পণ্য মুজতদারীর অভিযোগ উঠে। বর্তমানে সরকারী পণ্য আত্মসাতের অভিযোগ এনে ওই মেয়র প্রার্থীকে গ্রেফতার করতে রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছে স্বয়ং সরকারী দল।
এদিকে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে আন্দোলন করে পদ ছাড়া করার নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কাউন্সিলর মামুন মন্ডল। যারা মামুন মন্ডলের নির্দেশে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সরানোর আন্দোলন করেছেন, তারাই আজ মেয়র প্রার্থী হওয়ায় মামুন মন্ডলকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে জেলে ঢুকানোর চেষ্টায় রাজপথে নামলেন।
গোপন সূত্র বলছে, মেয়র প্রার্থী হওয়ার কারণে নাান অভিযোগে সরকারী দলের সাইফুল ইসলামকেও বহিঃস্কারের জন্য কাজ করছে সরকারী দলের কিছু লোক। ফলে “গাজীপুর সিটির মেয়রের চেয়ারে বসলেও খবর আছে এবং মেয়র হওয়ার নাম নিলেও খবর আছ ” বলে প্রবাদী বাক্য এখন চাওড় হয়ে গেছে।
রাজনীতি সচেতন মানুষ বলছেন, দুই জন মেয়রকে চেয়ার ছাড়া করা হয়েছে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে কোন অভিযোগ এখনো প্রামানিত হয়নি। অভিযোগ প্রমানের আগেই শাস্তি কার্যকর হওয়ায় মুখথুবরে পড়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আয়তনের গাজীপুর সিটিকর্পোরেশন। রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসী। একই সঙ্গে গাজীপুরে উন্নয়ন করতে গিয়ে বাঁধার সম্মুখিন হচ্ছে সরকারও। তবে মেয়র বা মেয়র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হলে কঠোর শাস্তি চান নগরের মানুষ।
গাজীপুর মহানগরের অনেক নাগরিক বলছেন, গাজীপুর সিটির দুইজন নির্বাচিত মেয়র গাজীপুর সদরের হওয়ার কারণেই হয়ত চেয়ারে বসে থাকতে পারছেন না। বার বার টঙ্গীর লোক মেয়র না হয়েও নির্বাচিত মেয়রকে চেয়ার থেকে সরিয়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। তারা আরো বলছেন, যারা মেয়র হওয়ার জন্য মাঠে নামছেন তাদেরও নির্বাচনে অযোগ্য করতে কাজ শুরু হয়ে গেছে। গাজীপুর সিটিকর্পোরেশনকে দুই ভাগে(গাজীপুর ও টঙ্গী) ভাগ না করলে উঠ-বস নীতির প্রচলন বন্ধ হবে না এমনটিও বলছেন অনেকে। নির্বাচিত মেয়র পুরো মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে না পারায় উন্নয়ন কাজও স্থবির হয়ে যায় বলে অভিমত তাদের।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, গাজীপুর সিটিতে মেয়রের চেয়ারে উঠ-বস করানো একটি রাজনৈতিক খেলা। মেয়র সরকারী দলের হউক বা বিরোধী দলের হউক মেয়াদ শেষের আগে মেয়রকে চেয়ার থেকে তোলে একই কাউন্সিলরকে দিয়ে দায়িত্ব পালন করানো রাজনৈতিক খেলাধূলার অংশ, না অন্য কিছু, তা বোধগম্য নয়। তারা বলছেন, এই সব না করে যাকে মেয়র পদে দিলে আর ষড়যন্ত্র হবে না তাকে খুঁজে বের করে মেয়রের চেয়ারে বসিয়ে দেয়াই উত্তম। এতে গাজীপুর মহানগর ও নগরবাসী উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হবে না।
এদিকে মেয়র বা মেয়র প্রার্থী হটানো আন্দোলনে রাজপথে থাকা একাধিক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, জাহাঙ্গীরকে হটানোর আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা মামনু মন্ডলের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন দুর্ভাগ্যজনক। জাহাঙ্গীর হটানোর আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকাদের মধ্যে মেয়র প্রার্থী হলেই আন্দোলন হবে এমনটি নয়। আর যদি হয় তবে জাহাঙ্গীর হটানো আন্দোলনের অনেক নেতাই দল থেকে ছিটকে পড়তে পারেন এমন ধারণাও অমূলক নয়। তারা বলছেন, জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের মামলা তদন্তাধীন। যদি তদন্তে অভিযোগ প্রমানিত না হয়, তবে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক আলামত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে মামলা হলে অনেক নেতাই ফেঁসে যেতে পারেন। ফেঁসে যাওয়াদের মধ্যে একাধিক সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী থাকবে না এমন ধারণাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জাহাঙ্গীর আলমের প্রকাশ্যে সামাজিক কর্মকান্ড ভবিষৎ শুভ ইঙ্গিত বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীর শিবিরের লোকজন।
এমতাবস্থায়, গাজীপুর সিটিমেয়রের চেয়ার নিয়ে রাজনীতির খেলা চলছে সেই শুরু থেকেই। মেয়রের চেয়ারে বসেও শান্তি নেই এবং মেয়র প্রার্থী হয়েও অশান্তি এমন হলে আসন্ন তৃতীয় নির্বাচনে গাজীপুর সিটির মেয়র হতে সহজেই চাইবে না কেউ। কারণ মেয়র হয়েও বিপদ এমনকি প্রার্থী হলেও বিপদ। এই অবস্থা থেকে মুক্তি চায় নগরবাসী।