বনানীতে চিননিদ্রায় সাবেক প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন আহমদ

Slider জাতীয়


সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের দ্বিতীয় জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। আজ রোববার সকাল ১০টায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণস্থ জাতীয় ঈদগাহ্ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার আগে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের পক্ষ থেকে সাবেক প্রেসিডেন্টের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এসময় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও মরহুম সাহাবুদ্দীন আহমদের পুত্র বাবার রুহের আত্মার মাহফিরাতের জন্য সবার কাছে দোয়া চান।

জানাজায় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকন, নাজিমউদ্দিন আলম, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দীন খোকন, বারের সাবেক সম্পাদক মোমতাজউদ্দিন মেহেদী ও সিনিয়র আইনজীবীগণসহ সহস্রাধিক মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

জানাজা শেষে সাহাবুদ্দীন আহমদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানে স্ত্রীর কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
এর আগে সাহাবুদ্দীন আহমদের প্রথম জানাজা গতকাল বিকালে তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার পাইকূড়া ইউনিয়নের পেইম গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়।

উল্লেখ্য, সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ শনিবার সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৯২ বছর বয়সী সাবেক এই প্রেসিডেন্ট কয়েক বছর ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন।

১৯৩০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার পেমই গ্রামে জন্ম নেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ছিলেন ফজলুল হক হলের ছাত্র।
১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জনপ্রশাসনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। তার বাবা তালুকদার রিসাত আহমেদ একজন সমাজসেবী ও এলাকায় জনহিতৈষী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অবশ্য বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কর্মজীবনের সূচনা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। পরবর্তী সময়ে সহকারী জেলা প্রশাসক হওয়ার পর ১৯৬০ সালে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগে বদলি হন। আসীন হন বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে। ১৯৮০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দীন আহমদকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করা হয়। বিচারপতি হিসেবে তার প্রদত্ত বহুসংখ্যক রায় প্রশংসিত। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তার প্রদত্ত রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। এ রায়ে তিনি অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে নিজস্ব ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করা, গোষ্ঠী শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক মানবাধিকার খর্ব করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জনগণের সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অস্বীকৃতি এবং আইনের শাসনের পরিবর্তে আদেশ জারির মাধ্যমে সংবিধান রহিত করার প্রবণতার জন্য তৃতীয় বিশ্বের একনায়ক শাসকদের সমালোচনা করেন। বিচার বিভাগে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও ছুটির ক্ষেত্রে হাইকোর্টের চিরাচরিত ক্ষমতা খর্ব করা এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক নিম্ন আদালতগুলো নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তৎকালীন সরকার তার সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ১৯৭৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালের ১৪ই জানুয়ারি তাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। ওই বছরের ৬ই ডিসেম্বর এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। ওই দিনই রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করে উপ-রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর ফলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সরকার প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন এবং নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করেন। ওই সময় সরকার প্রধান হিসেবে তিনি বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বেশকিছু আইন সংশোধন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে ভূমিকা পালন করেন। সাহাবুদ্দীন আহমদের ইচ্ছায় দেশের সংবিধানের ১১তম সংশোধনীটি আনা হয়। এর ফলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পরও তিনি ১৯৯১ সালের ১০ই অক্টোবর প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে সুপ্রিম কোর্টে ফিরে যান এবং ১৯৯৫ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সাহাবুদ্দীন আহমদ আবারো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ওই বছর ক্ষমতায় এসে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। ১৯৯৬ সালের ৯ই অক্টোবর তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ২০০১ সালের ১৪ই নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *