আজ বিশ্ব ঘুম দিবস। প্রতি বছর মার্চ মাসের তৃতীয় শুক্রবার দিবসটি পালিত হয়। ২০০৮ সালে প্রথমবার দিবসটি পালন করে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব স্লিপ মেডিসিন’ এর ওয়ার্ল্ড স্লিপ ডে কমিটি। ঘুমের অভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বিষয়ে মানুষকে জানানোই ছিল এই কমিটির মূল উদ্দেশ্য।
বিশ্ব ঘুম দিবস মূলত ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব স্লিপ মেডিসিনের অর্থায়নে অনুষ্ঠিত বার্ষিক ইভেন্ট। এ বছর এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ‘গুনগত ঘুম, সুস্থ মন, সুখী পৃথিবী’।
আজকাল আমরা ঘুমের ক্ষেত্রে যেন ‘ব্যাংক্রাপ্ট’ হয়ে যাচ্ছি। পুরো বিশ্বের পূর্ণবয়স্ক মানুষদের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ সঠিকভাবে ঘুমান না। ‘World health organization’ তাই এই ‘sleep loss’ এর সমস্যাকে এখন ‘এপিডেমিক ‘ঘোষণা করেছে।
আসলে খাদ্য বাসস্থানের মতো ঘুমও কিন্তু বেঁচে থাকার অপরিহার্য একটি শর্ত। খাবার কিনতে পয়সা লাগে, অথচ ঘুম কিনতে হয় না, তবু ঘুমাই না আমরা। আজকাল ৭৮-৭৯ রকমের ‘স্লিপ ডিসঅর্ডার’ আছে।
রাতের ঘুম ঠিক না হলে পরের দিন সকালে সারাদিন তার প্রভাব থাকছে। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, বাচ্চারা স্মৃতি হারায়, মেধা কমে যায়। বড়রা হৃৎপিণ্ডের এবং স্নায়ুর সমস্যায় পড়েন। ‘ওবেসিটি’, ‘ডায়াবেটিস’, ‘অ্যালঝাইমার’ এর সম্ভাবনা বাড়ে।
‘WHO’ বলছে ‘chronic sleep deprivation’, ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে কম ঘুমের জন্য।
আমাদের ‘স্লিপ হাইজিন’ মেনে চলা উচিত। আজকাল আমরা বহু রাত পর্যন্ত মোবাইল ঘাঁটি, আবার ভোরে আল্যার্ম দিয়ে উঠি। অথচ প্রয়োজন কিন্তু উল্টোটা করার। প্রয়োজনে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমাতে যান। মানে সঠিকভাবে ঘুমান। ঘুমাতে যাওয়ার এক দু’ঘণ্টা আগে থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ থেকে দূরে থাকুন। মেলাটোনিন হরমোন, যা আমাদের ঘুমাতে সাহায্য করে, সেটা বিকেলের রোদ গায়ে লাগিয়ে বাড়িয়ে নিন। ঘুম ছাড়া বিছানায় সময় কাটানোর দরকার নেই। ঘুমের সময় বিছানা আপনাকে আপন করে নেবে। এটুকুই সম্পর্ক থাক। প্রয়োজনে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটু স্নান করে নিন। চা-কফি বাদ দিন ঘুমনোর আগে। আর সুযোগ পেলে ভাতঘুমও দিন পনের কুড়ি মিনিটের জন্য।’
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘মোবাইলের চার্জ যেমন করে ফুরিয়ে যায়, চার্জ দিতে হয়, ঠিক সেরকমভাবেই আমাদের মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্রকে নিজেদের মতো করে চার্জ করে নিতে হবে। আমাদের সকলের নিজস্ব শারীরিক ছন্দ আছে, সেই মতো খাপে খাপে ঘুমানো দরকার। এই pandemic situation এ অনেকেরই ঘুমের ধরনে বদল এসেছে। কেউ কেউ রাতে জাগেন বেশি, দিনে ঘুমান বেশি। কেউ আবার উল্টোটা, কাজেই শারীরিক প্রয়োজনেই আমাদের সুবিধা মতো ঘুমিয়ে নিতে হবে। জেগে থাকার সময়টুকু সঠিকভাবে কাজে লাগাতেই দৈনন্দিন ঘুমটুকু সঠিকভাবে সেরে নিতে হবে।’
সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের অভিমত, নিজে ঘুমাতে ভীষণ ভালোবাসেন। কাজেই ঘুমের প্রয়োজনীয়তা সবসময় তার কাছে আলাদা। মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করেন তিনি গোটা রাজ্য জুড়ে। তিনি বলেছেন, নিয়ম মেনে সকলকেই খাওয়া ঘুমের অভ্যাস করান তারা।
তিনি আরও বলছেন, অনেকেই মনে করেন, যারা বলেন বেশি ঘুমান মানেই অলস মানুষ, তারা হয়তো ঠিক বলেন না। হতেই পারে শরীরের শক্তিটুকু তারা জুটিয়ে নেন ঘুমের মাধ্যমেই। আর কেউ নার্ভের ওষুধ খেলেই সে অতিরিক্ত ঘুমে ঢলে পড়েন তা কিন্তু না। আসলে জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে করতে কোথাও একটা আমাদের সকলকেই কখনও না কখনও একটু আশ্রয়হীনতা গ্রাস করে, সে সময়ে ঘুমের চেয়ে আরাম কিন্তু আর কোনও কিছুতে পাওয়া যায় না।’
অতএব বুঝলেন তো, বন্ধু আত্মীয় স্বজন যে যাই বলুক, আপনাকে সুস্থ থাকতে, জীবনের পিচে বেশিদিন টিকে থাকতে নিজের ঘুমটুকু নিজেকেই ঘুমিয়ে নিতে হবে।
নিত্যদিনের হাজারো টেনশনে মানুষ যেন আজ যন্ত্র। ঘুম যেন উধাও অনেকের চোখ থেকে। কোনও চিন্তা মাথায় না রেখে, পরম শান্তিতে কে কবে ঘুমাতে গিয়েছে সেই স্মৃতি মনে নেই।
ঘুম কম হওয়ার ফলেই হাইপার টেনশন, পেটের অসুখ জাতীয় একাধিক রোগ বাসা বাঁধছে শরীরে। ঘুমের গুরুত্ব যেমন আমরা উপলব্ধি করতে পারি না, তেমনই উপলব্ধি করি না বিশ্ব ঘুম দিবস বলেও একটি দিন পালন করা হয় গোটা পৃথিবীজুড়ে। শুক্রবার সেই বিশ্ব ঘুম দিবস। ঘুম ও ঘুমের উপযোগিতা বোঝাতে ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি ২০০৮ সাল থেকে এ দিনটি উদযাপন করে। প্রতিবছর সূর্যের দক্ষিণায়নের আগের শুক্রবার বিশ্ব ঘুম দিবস পালন করা হয়।
ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটির সদস্যরা প্রত্যেকেই ঘুম নিয়ে গবেষণা করেন। ঘুমের ওষুধ ও ঘুমের গুরুত্ব নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চালাচ্ছেন এরা। মানুষের শরীরে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করার জন্যই এই বিশেষ দিনটি উদযাপন করা শুরু করেন তারা।
তাদের মূল মন্ত্র, ‘বেটার স্লিপ, বেটার লাইফ, বেটার প্ল্যানেট।’ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ঘুমের কোনও বিকল্প নাই। তাই অনেক দিবসের ভিড়ে আজ বিশ্ব ঘুম দিবস। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বের বহু দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবারের বিশ্ব ঘুম দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘গুণগত ঘুম, সুস্থ মন, সুখী পৃথিবী’।
প্রথমবার এই দিবসটি পালন করে ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব স্লিপ মেডিসিন’ এর ওয়ার্ল্ড স্লিপ ডে কমিটি। এই কমিটির মূল উদ্দেশ্য, ঘুমের অভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বিষয়ে মানুষকে অবগত করা।
কাজেই নিজেকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত পরিমিত ঘুমান। নিজেকে দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখুন। লোভকে পরিহার করে যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিন। সুস্থ-সুন্দর জীবনের এসবের কোনও বিকল্প নেই।
লেখক: নাক-কান ও গলারোগ বিশেষজ্ঞ