এবার দুধের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আর এ উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে সংসদীয় কমিটি। মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরও সায় রয়েছে। একটি সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি ওই উদ্যোগের বিরোধিতা করলেও তা ধোপে টেকেনি। এদিকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর সায় থাকায় সংসদীয় কমিটির তিন এমপিসহ মন্ত্রণালয়ের প্রায় এক ডজন কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। এমনকি তারা নিজেদের মতামতও জানাননি। ঘটনাটি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির। সম্প্রতি ওই কমিটির ১০ম বৈঠকের কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে।
তাতে এসব তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে।
কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন ফরিদপুর-৩ আসনের এমপি খোন্দকার মোশাররফ হোসেন। সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, সংসদ সদস্য মশিউর রহমান রাঙ্গা, শেখ আফিল উদ্দিন, বেগম রেবেকা মোমিন ও আব্দুস সালাম মুর্শেদী। কর্মকর্তাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. মশিউর রহমান এনডিসি, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (সচিব-এর রুটিন দায়িত্বে) মরণ কুমার চক্রবর্তী, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশীদ খান, আমার গ্রাম আমার শহর প্রকল্পের উপদেষ্টা ড. কাজী আনোয়ারুল হক, অতিরিক্ত সচিব মুহম্মদ ইব্রাহীম, মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমর চান বণিক, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এর প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান, সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক ড. মো. হারুন অর রশিদ বিশ্বাস এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বৈঠকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি বলেন, দেশে যেহেতু সকল জিনিসের দাম বেড়েছে সেহেতু মিল্ক ভিটা দুধের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব উত্থাপন করা যেতে পারে। বর্তমানে দেশের বাজারে একমাত্র দুধ ছাড়া সকল জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বগতি। এর ফলে গরু চাষিরা গরু পালনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উপরে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং দুধের দাম এর একটি সিলিং থাকা দরকার বলে জানান। প্রতি জেলায় মিল্ক ভিটার ছোট ফ্যাক্টরি করা দরকার। দুধের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাহিরের আমদানি বন্ধ করতে হবে। এনবিআরকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা দরকার।
এরই আলোকে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুধের দাম না বাড়ার কারণে দুগ্ধ খামারিরা তাদের দুধের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। আমাদের দেশে খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে এলাকায় বেশি দুধ উৎপাদন হচ্ছে সেখানে ছোট ফ্যাক্টরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে দুধের পরিবহন খরচ কমে যাবে, অপচয় কম হবে। গৃহীত পাইলট প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে প্রয়োজনে পর্যায়ক্রমে দুধের দাম আরও বাড়ানো যাবে। কার্যবিবরণী অনুযায়ী বৈঠকে দুধের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের বিরোধিতা করেন সংসদ সদস্য বেগম রেবেকা মোমিন। তিনি বলেন, মিল্ক ভিটার আধা লিটার দুধ বর্তমানে ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় এই দুধের দাম আরও বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষ দুধ ক্রয় করতে পারবে না।
ওই বৈঠকে দুধের বাজার নিয়েও আলোচনা করেন সংশ্লিষ্টরা। এতে অংশ নিয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, দেশের বিভিন্ন কোম্পানি বিদেশ থেকে নিম্নমানের এবং মেয়াদোত্তীর্ণ পাউডার দুধ আমদানি করে তা লিক্যুইড করে বাজারে বিক্রি করছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তিনি বিদেশ থেকে পাউডার দুধ আমদানি নিষিদ্ধ করে দেশে দুধের উৎপাদন আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়ার ওপরে গুরুত্বারোপ করেন। এ সময় প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন কোম্পানি বিদেশ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের পাউডার দুধ আমদানি করে বাজারে বিক্রি করছে। তিনি বিদেশ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের পাউডার দুধ আমদানি নিষিদ্ধ করার ওপরে গুরুত্বারোপ করেন। দেশে যে দুধ উৎপাদন হয় তাতে দেশ দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
দুধের উৎপাদন আরও বাড়াতে পারলে ৫৫-৬০ টাকায় দুধ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে জানান। পরে আলোচনায় অংশ নিয়ে মন্ত্রী বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পাউডার দুধ যেসব পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে আসে সেসব জায়গায় উক্ত দুধের গুণগত মান সঠিক আছে কিনা তা যাচাই করে ছাড়করণের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে কমিটি থেকে সুপারিশ করার জন্য সভাপতিকে অনুরোধ জানান। জবাবে সভাপতি দুধের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গ্রামের প্রতিটি পরিবারকে উন্নতজাতের গাভী পালনের নিমিত্ত ইনসেনটিভ প্রদানের প্রস্তাব সরকারের নিকট উপস্থাপনের পরামর্শ দেন। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পাউডার দুধের সঠিক গুণগত মান নিশ্চিত সাপেক্ষে দুধের ছাড়করণ এবং উক্ত দুধ আমদানিতে ট্যাক্স ধার্য করার সুপারিশ প্রদান করেন।
এদিকে দুধের বাজার ইস্যুতে আলোচনায় অংশ নিয়ে আমদানিকৃত ফ্যাট ও ননফ্যাট গুঁড়োদুধের ট্যারিফ ২০ ভাগ বৃদ্ধি করা প্রসঙ্গে মিল্ক ভিটার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, দেশের প্রান্তিক দুগ্ধ খামারিদের উৎপাদিত তরল দুধ সম্পূর্ণ সংগ্রহ করার নিমিত্ত সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে গুঁড়োদুধ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার বাঘাবাড়ীঘাটে গুঁড়োদুধ কারখানা স্থাপনের কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ উক্ত গুঁড়োদুধ প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শেষ হলে প্রতিদিন প্রায় ৩০ টন গুঁড়োদুধ উৎপন্ন হবে যা বছরে আমদানিকৃত গুঁড়োদুধের একটি বৃহৎ অংশের বিকল্প হিসেবে ভোক্তা সাধারণের হাতে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তারা জানান, গুঁড়োদুধের আমদানির বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন আমদানিকারকবৃন্দ গুঁড়োদুধ আমদানি করে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩৪৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার টন গুঁড়োদুধ আমদানি করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের উৎপাদিত দুধের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ক্রমশ: আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে বাংলাদেশের দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিলম্বিত হবে। এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের উৎপাদিত গুঁড়োদুধের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং গুঁড়োদুধের আমদানি নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিশাল অঙ্কের ট্যারিফ ধার্য করেছে। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়, কানাডা ২৪৬.৯ ভাগ, জাপান ১১৬.৯ ভাগ, ইইউ ৫৪.৭ ভাগ, ভারত ৬৮.২৭ ভাগ পাকিস্তান ৬০ ভাগ, বাংলাদেশ ৩৭ ভাগ ও তুরস্ক ১৮০ ভাগ। কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ভারত ও পাকিস্তান গুঁড়োদুধ আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং দেশীয় কৃষকের উৎপাদিত দুধের বাজারমূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভ্যস্ত যৌক্তিক হারে ট্যারিফ বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশে আমদানিকৃত গুঁড়োদুধের ওপর ট্যারিফ কম থাকায় দেশে উৎপাদিত গুঁড়োদুধের সঙ্গে আমদানিকৃত গুঁড়োদুধের মূল্য পার্থক্যের জন্য দেশীয় দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং দুধের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ক্রমান্বয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এমতাবস্থায়, দেশের লাখ লাখ প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদিত দুধের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে দুগ্ধ শিল্পকে জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সার্কভুক্ত দেশগুলোর ন্যায় আমদানিকৃত গুঁড়োদুধের ওপর (শিশু খাদ্য ব্যতীত) বর্তমান বিদ্যমান ট্যারিফ হতে কম পক্ষে ২০ ভাগ ট্যারিফ বৃদ্ধি করার জন্য চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বরাবর পত্র দেয়া যেতে পারে।