দেশে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার মসলার বাজার বিদ্যমান। তবে এই মসলার চাহিদার বড় অংশ পূরণ হচ্ছে বিদেশ থেকে আনার মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪০-৪২ শতাংশ মসলার চাহিদা মেটে আমদানির মাধ্যমে। অবৈধ পথে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হচ্ছে এসব মসলা। এখন দেশে মসলার চাষ বাড়াতে নেয়া প্রকল্পে পরামর্শকের পেছনে খরচ হবে এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। আর এ জন্য ২৭ জন কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ সফরে যাবেন। যাদের পেছনে মাথাপিছু খরচ পাঁচ লাখ টাকা হিসেবে মোট এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় হবে। মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে নেয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ১৪৯.৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
কৃষি অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বিশ্ববাজারে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মসলার রয়েছে উচ্চমূল্য। এটা কম আয়তনিক পণ্যজাতীয় দ্রব্য। উদ্ভিদের কুঁড়ি, ফল, বীজ, বাকল, রাইজম এবং কন্দ। খাদ্যের রং, সুগন্ধি, সুস্বাদু এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত উপাদান হলো মসলা। বিশ্বে ১০৯ রকম মসলা জন্মে। যার মধ্যে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ প্রধান মসলাই বাংলাদেশে জন্মে। দেশে প্রায় ৫০ ধরনের মসলা ব্যবহার হয়ে থাকে। বেশ কিছু জাতের দামি মসলা এখনো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আবার অবৈধ পথেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে। এ ক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর সুযোগ থাকলেও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশে মসলার বাজার হলো ৩০ হাজার কোটি টাকার। এ ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা কমাতে স্থানীয়ভাবে মসলার উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
মসলা গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক ২২টি মসলা জাতীয় ফসলের ওপর এ পর্যন্ত সর্বমোট ৪৭টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। তা ছাড়া উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উৎপাদন প্রযুক্তি, মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, পোস্ট-হারভেস্ট প্রযুক্তিসহ আরো ৬৬টি উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে।
কৃষি অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে উৎপাদিত মসলার পরিমাণ ৩৫ লাখ টনেরও বেশি। আর প্রতি বছর অতিরিক্ত ১৪ লাখ টন চাহিদা পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মসলার উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৯ লাখ টন। এসব মসলার চাষ হয়েছে পাঁচ লাখ ৫১ হাজার ৩৪৯ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে কাঁচামরিচ ছয় লাখ ৫৮০ টন, শুকনা মরিচ দুই লাখ ২৬ হাজার ৩১১, পেঁয়াজ ১৯ লাখ ৫৮ হাজার ৫৪৪, রসুন পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৮৩৩, আদা দুই লাখ ২৩ হাজার ২৪৩, হলুদ তিন লাখ ১৫ হাজার ৪২২, দারচিনি সাড়ে ৯, তেজপাতা দুই হাজার ১৫৩, কালোজিরা ১২ হাজার ৯১৯, ধনিয়া ৭০ হাজার ৪৬৫, গোলমরিচ ছয় টন ও অন্যান্য মসলার উৎপাদন হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৭ টন।
কৃষি গবেষণার এক তথ্যে জানা গেছে, দেশে ৫০ রকম মসলা ব্যবহৃত হয়। তার মধ্যে ১৭ রকম মসলা এদেশে উৎপাদিত হয়। দেশে প্রধান কিছু মসলা যেমন, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও হলুদের পাশাপাশি কিছু অপ্রধান মসলা যেমন, ধনিয়া, মেথি, কালোজিরা, মৌরি, গোলমরিচ, শলফা ও জোয়ানের চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। জিরা এলাচ, দারুচিনি লবঙ্গ, জয়ফল, পেস্তা বাদাম ইত্যাদিসহ অবশিষ্ট ১০ প্রকার মসলা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে মসলার চাহিদা ৩১ দশমিক ৫৪ টন, তার মধ্যে তিন লাখ ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে ২৪ লাখ ৮৮ হাজার টন উৎপাদিত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ঘাটতি মেটানোর জন্য আরো ছয় লাখ ৬৬ হাজার টন মসলা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে ইতোমধ্যে ১৯ রকম মসলার ৩৮টি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত কাজগুলো হলো, ২৯ হাজার ৯২৯টি মসলা প্রদর্শনী ও চারা-কলম আমদানি, ৫০১টি বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় ও বিতরণ, তিনটি অফিস কাম ট্রেনিং সেন্টার, ভূমি উন্নয়ন, ১৮৫টি বিভিন্ন ধরনের শেড নির্মাণ, ২৭ শ’ ব্যাচ কৃষক প্রশিক্ষণ, ৫০ ব্যাচ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ, ৩০ ব্যাচ কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ, দুই ব্যাচ বৈদেশিক দক্ষমতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, ১৩৫ ব্যাচ কৃষক উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ, পাঁচটি জাতীয় কর্মশালা, এক হাজার ৬৫০ ব্যাচ কৃষক মাঠ দিবস ও কারিগরি আলোচনা।
ব্যয়ের হিসাবের তথ্য থেকে জানা গেছে, এই মসলার চাষ সম্পর্কে জানতে ২৭ জন কর্মকর্তা বিদেশ যাবেন, যাদের জন্য মাথাপিছু সরকারি ভাণ্ডার থেকে পাঁচ লাখ টাকা হারে ৯০ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। আর শস্য বিন্যাসে একজন পরামর্শক ও ভেলুচেইন বাজারের জন্য একজন এবং একটি ফার্ম নিয়োগে খরচ হবে এক কোটি ৩৬ লাখ টাকা। তবে এই সব খরচ অযৌক্তিক বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশনের ফসল উইং।
এর আগে নেয়া হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) অধীনস্থ কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের (তৃতীয় পর্যায়) কাজ। কিন্তু শেষ বেলায় এসেও ডাল, তেল ও মসলা চাষ শিখতে তুরস্কে সফরে যাচ্ছেন ২০ কর্মকর্তা। তাদের বিদেশ যাত্রায় অনুমতিপত্র (জিও) জারি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সাত দিন থাকবেন সেখানে। এবার ২০ কর্মকর্তার তুরস্কে সফরে ঠিক কত টাকা খরচ হবে তা সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে তাদের প্রত্যেকের পেছনে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা করে ব্যয় হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২০ জন করে মোট ৪০ জন কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। তারা চীন ও ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন। তাদের জনপ্রতি চার লাখ ৩৮ হাজার টাকা খরচ ধরা হয়। আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় পাঁচ দফায় মোট ১০০ জন কর্মকর্তার বিদেশ প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয় চার কোটি ৩৮ লাখ আট হাজার টাকা। তৃতীয় দফায় ২০ জন কর্মকর্তা তুরস্ক সফরে যাচ্ছেন। আরো ৪০ জন কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ বাকি থাকল ওই প্রকল্পে। এ বিষয়ে জানতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: বেনজীর আলমকে ফোন দিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের ফসল উইং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাাতি, কম্পিউটারসহ প্রকল্পে বিভিন্ন জিনিসপত্রের ক্রয়মূল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রাক্কলনগুলো যুক্তিযুক্ত নয়। কৃষি খাতের এই প্রকল্পে এত বেশি পরামর্শক ও বিদেশ ভ্রমণের যৌক্তিকতা নিয়েও তারা আপত্তি তুলেছেন। এই ধরনের একটি প্রকল্প বর্তমানে চলমান আছে। আবারো পাঁচ বছরের জন্য এই বিরাট অর্থের একটি প্রকল্প। এখানে ব্যয়কে যুক্তিযুক্ত করতে বলা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) শরিফা খানের মুঠোফোনে গতকাল যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।