চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন স্বামী পরিত্যক্তা এক নারী। অসহায় এই নারী কাজ করতেন নগরের একটি পোশাক কারখানায়। কর্মস্থলে গেলে বাসায় একা থাকতে হতো তার পাঁচ বছর বয়সী কন্যাশিশুকে। তাকে দেখভাল করতেন পাশের বাসার আরেক নারী। তবে এরই মধ্যে তার ওপর নজর পড়ে এক ব্যক্তির। একদিন সবার অগোচরে তাকে ধর্ষণ করতে যায় ওই ব্যক্তি। ধর্ষণের সময় ধস্তাধস্তিতে শ্বাসরোধে নিহত হয় শিশুটি। খাটের নিচে শিশুটির মরদেহ ফেলে চলে যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি। গত বছরের ২৭ জুন এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার দুদিন পর পুলিশ অভিযুক্ত ইমনকে গ্রেফতার করে।
একই বছরের ২৭ মে রাতে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় পূর্বপরিচিত এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান এক নারী পোশাককর্মী। এসময় তিন ব্যক্তি মিলে মারধর করে তাড়িয়ে দেন ভুক্তভোগী নারীর বন্ধুকে। পরে অভিযুক্ত তিনজনে মিলে ওই নারীকে নিয়ে যান পাশের একটি পরিত্যক্ত ঘরে। সেখানে তাকে দুজন মিলে ধর্ষণ করে। একজন বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী বাদী হয়ে একটি ধর্ষণ মামলা করেন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত সাইফুর রহমান সুমন (২৮), মেহেদী হাসান জনি (৩২) ও মো. আলমকে (২৫) গ্রেফতার করে।
ধর্ষণের ঘটনা যতটা প্রকাশ্যে আসে, তার চেয়ে বেশি অপ্রকাশ্যে থেকে যায়। আবার বেশিরভাগ নারী কাছের মানুষ দ্বারা ধর্ষিত হন। আমি এমন ঘটনাও দেখেছি, নবম শ্রেণির এক ছাত্রী তার ফুফাতো ভাইয়ের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে। তার বাবা-মা জেনেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো ফুফাতো ভাই ওই মেয়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক করেছেন
শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়, চট্টগ্রাম শহরে ২০২১ সালে এ রকম ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৫১টি। এর মধ্যে জোরপূর্বক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি। এছাড়া ফুসলিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৫৩টি। নগরের ১৬টি থানায় খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ধর্ষণের শিকার যারা
ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া অর্ধশতাধিক মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই শিশু, কিশোরী এবং তরুণী। যাদের বয়স পাঁচ থেকে ২৫ বছর। শতকরা হিসাবে ৬০ শতাংশের বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন এসব বয়সের নারী। তারা হয় ফুসলিয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন নতুবা জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন।
থানাভিত্তিক ধর্ষণের চিত্র
চট্টগ্রাম শহরে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায়। শুধু এই থানায় এক বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৮টি। এর মধ্যে ১৪টি জোরপূর্বক এবং ২৪টি ফুসলিয়ে। নগরের মধ্যে সবচেয়ে কমসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সদরঘাট থানা এলাকায়। সেখানে জোরপূর্বক দুটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ফুসলিয়ে এবং জোরপূর্বক মিলিয়ে নগরের কোতোয়ালি থানায় ১৬, চকবাজার থানায় পাঁচ, বাকলিয়া থানায় ১৪, খুলশী থানায় আট, পাঁচলাইশ থানায় ১৬, চান্দগাঁও থানায় ২৮, পাহাড়তলী থানায় ২৭, আকবরশাহ থানায় ১৭, হালিশহর থানায় ৯, ডবলমুরিং থানায় ১৫, বন্দর থানায় ১১, ইপিজেড থানায় ১১, পতেঙ্গা থানায় ২৩ এবং কর্ণফুলী থানায় ১১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটা বায়েজিদ বোস্তামী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম বলেন, আমাদের থানা এলাকায় শিল্পকারখানা বেশি। এসব কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক ভাসমান। তাছাড়া এটি রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িসহ দুই জেলার প্রবেশমুখ। আবার পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তবে আমরা প্রতিটি ঘটনায় যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছি।
চট্টগ্রাম শহরে ২০২১ সালে এ রকম ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৫১টি। এর মধ্যে জোরপূর্বক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি। এছাড়া ফুসলিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৫৩টি। নগরের ১৬টি থানায় খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে
গত পাঁচ বছরে নগরের ধর্ষণ মামলার চিত্র
২০১৭ সালে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন থানা মিলিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয় ১০৮টি, ২০১৮ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০টিতে। এরপর ২০১৯ সালে নগরে ধর্ষণের মামলা হয় ১৯৫টি এবং ২০২০ সালে হয় ২৪৮টি। সবশেষ ২০২১ সালে ২৫১টি। অর্থাৎ প্রতি বছরই বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৌমিতা পাল জাগো নিউজকে বলেন, ধর্ষণের ঘটনা যতটা প্রকাশ্যে আসে, তার চেয়ে বেশি অপ্রকাশ্যে থেকে যায়। আবার বেশিরভাগ নারী কাছের মানুষ দ্বারা ধর্ষিত হন। আমি এমন ঘটনাও দেখেছি, নবম শ্রেণির এক ছাত্রী তার ফুফাতো ভাইয়ের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে। তার বাবা-মা জেনেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো ফুফাতো ভাই ওই মেয়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক করেছেন। আমাদের পরিবার, সমাজ সচেতন নয় বলে আমার ধারণা এ ধরনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) শামসুল আলম বলেন, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ হলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তদারকি করি। কেন ঘটনা ঘটলো, এর পেছনে কারণ কী- এসব জানার চেষ্টা করি। যতক্ষণ এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন না হয় ততক্ষণ আমরা লেগে থাকি। চট্টগ্রামে ধর্ষণের ঘটনা একটু বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে শিল্পকারখানা ঘিরে শ্রমিক থাকা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন বলেন, দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটার কারণ হচ্ছে উপযুক্ত শাস্তি কম হচ্ছে। সেটি পুলিশের তদন্তের গাফিলতিতে হোক কিংবা আইনের কোনো জটিলতা থেকেই হোক। আবার যে শাস্তি হচ্ছে তা প্রকাশ্যে কম আসছে। ধর্ষণ এবং তার শাস্তির ভয়াবহতা আমাদের বেশি করে প্রচার করতে হবে। নারীদের নিজেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হবে। দেশে পর্নো সাইট বন্ধ করতে হবে। বাজারে সেক্সুয়াল পণ্য সহজে পাওয়া যায়। এটিও বন্ধ করতে হবে। ধর্ষণ কমাতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে।
ধর্ষণ মামলার আইন ও শাস্তি
এক সময় ধর্ষণের ঘটনার বিচার করা হতো দণ্ডবিধি আইনে। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশদের প্রণয়ন করা এই আইনের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে- ‘কোনো পুরুষ পাঁচটির যে কোনো অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করলে তিনি ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে। এগুলো হলো- প্রথমত নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দ্বিতীয়ত নারীর সম্মতি ছাড়া; তৃতীয়ত নারীর সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে সম্মতি আদায় করা হলে; চতুর্থত নারীর সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানেন যে তিনি স্ত্রী লোকটির স্বামী নন এবং পুরুষ জানেন যে স্ত্রী লোকটি তাকে এমন অন্য একজন পুরুষ বলে ভুল করেছেন যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসম্মতভাবে বিয়ে হয়েছে বলে বিশ্বাস করেন; পঞ্চমত নারীর সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে, যদি ভুক্তভোগীর বয়স ১৪ বছরের কম হয়।’
এই আইনের ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি ধরা হয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণের অপরাধ করে, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি যাবজীবন কারাদণ্ডে অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন, যদি না ধর্ষিতা নারী তার নিজের স্ত্রী হয় ও ১২ বছরের কম বয়সের না হয়। যদি এ রকম হয়, তবে ওই ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন।’
তবে বর্তমানে ধর্ষণের বিচার হয় ২০০০ সালে প্রণয়ন করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এই আইনে বহাল রাখা হয়েছে দণ্ডবিধি আইনে দেওয়া ধর্ষণের সংজ্ঞা। তবে আগে নির্দিষ্ট মেয়াদের কারাদণ্ড, যাবজ্জীবন দণ্ড থাকলেও এ আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা এখন মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। ২০০০ সালে প্রণয়ন করা এই আইন সবশেষ ২০২০ সালে সংশোধন করা হয়। বর্তমানে এ আইনের অধীনে ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বিচার করা হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে।
তবে ধর্ষণের মামলায় শাস্তি বাড়ানো হলেও কমছে না এ অপরাধের সংখ্যা। উল্টো দিন দিন বাড়তির দিকে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন বলেন, বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রতা এবং অনেক সময় বিভিন্ন কারণে প্রকৃত অপরাধী শাস্তির আওতার বাইরে থাকায় ধর্ষণের মাত্রা বাড়ার মূল কারণ। এছাড়া নিজেদের ধর্মীয় অনুশাসন কম মানা, নৈতিক অবক্ষয় ও মানসিক বিকৃতিতে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।
ধর্ষণের বিষয়ে বিভিন্ন ধর্ম যা বলছে
নারী নির্যাতনের নিকৃষ্ট রূপের একটি হচ্ছে ধর্ষণ। এটি গুরুতর এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় সব ধর্মে। এই অপরাধে না জড়াতে গুরুত্বের সঙ্গে বারণ করা হয়েছে প্রত্যেক ধর্মে। তারপরও প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন অপরাধ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ইসলাম ধর্মে এটি কবিরা (সর্বোচ্চ) গুনাহের কাজ। এ কাজ তো দূরের কথা, এটির ধারেকাছেও না যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে ইসলামে। এ ধরনের অপরাধে জড়িত হলে পরকালে কঠিন শাস্তির কথা পবিত্র কোরআন-হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক শিপককৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, আমাদের হিন্দু ধর্মে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদেও বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।