বিনা ভোটের নির্বাচন যে কিভাবে হয় এবং কোনো ভোট ছাড়াই একদল লোক কিভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান তা আমরা কোনো দিনই জানতে পারতাম না যদি আমাদের জাতীয় জীবনে ২০১৪ সাল না আসত এবং সে বছর যদি দশম সংসদ শিরোনামে কোনো নির্বাচন না হতো। বিনা ভোটের নির্বাচনে আমি ছিলাম একজন পর্যবেক্ষক এবং রাতের ভোটের নির্বাচনে ছিলাম ভুক্তভোগী। সুতরাং এই দু’টি নির্বাচন সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনলে আপনারা খুব সহজেই নয়া সিইসি হাবিব উল আউয়াল পরিচালিতব্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেমন হবে তা খুব সহজে অনুমান করতে পারবেন।
আজকের শিরোনাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার আগে সিইসি হাবিব উল আউয়াল নামের মাহাত্ম্য সম্পর্কে কিছু বলা আবশ্যক। আমাদের দেশের ধর্মবিশ্বাসী লোকজন বিশ্বাস করেন যে, মানুষের নামের সাথে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অন্য দিকে, জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে মানুষের রাশিফল ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা করতে গিয়ে বিশ্বের প্রায় সব নামকরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী মানুষের নামের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তো সেই হিসেবে আমরা যদি হাবিব উল আওয়াল নামের অর্থ খুঁজি তবে ভদ্রলোক সম্পর্কে হয়তো কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারব। হাবিব শব্দের অর্থ বন্ধু এবং এই বন্ধু হলো বস্তুগত বন্ধু। আরবিতে আরো দুই ধরনের বন্ধুত্ব রয়েছে যাদের একটির নাম হামিম। আর হামিম হলো সেই বন্ধু যে কিনা বিপদের সময় অন্য বন্ধুকে ফেলে পালিয়ে যায় না। হামিম ছাড়া আরেক শ্রেণীর বন্ধু রয়েছে যাদের বলা হয় মাহবুব। মানুষ যখন পার্থিব লোভ লালসা-কামনা-বাসনা ভুলে সত্যিকারার্থে কারো প্রেমে মুগ্ধ হয় তখন তাকে মাহবুব বলা হয়ে থাকে।
উল্লিখিত বর্ণনা মতে, আপনি যদি হাবিব উল আউয়াল শব্দের ব্যাখ্যা খোঁজেন তবে এমন এক ব্যক্তির নাম পাবেন যিনি শুরু থেকেই কারো বন্ধু ছিলেন এবং সেই বন্ধুত্ব হামিম অথবা মাহবুবের মতো নয়। অর্থাৎ এই বন্ধুত্বের বিনিময়ে জাগতিক লেনাদেনা, লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা ইত্যাদি সব কিছুই বিদ্যমান ছিল। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় প্রথম থেকেই তিনি কার বা কাদের বন্ধু ছিলেন তা বোঝার জন্য আপনাকে উল শব্দটির ব্যাকরণগত অর্থ খুঁজতে হবে এবং হাবিব ও আউয়ালের মাঝখানে যদি উল যুক্ত হয় তবে বন্ধুত্বের ধরন ও প্রকৃতির সাথে সাথে পরিধিও নির্দিষ্ট করা যায়।
যাহোক, নামের ব্যাখ্যা নিয়ে আজকের নিবন্ধে আর বিশেষ কিছু বলব না। তবে তার চাকরি জীবন-সিইসি হিসেবে নিয়োগ লাভ এবং নিয়োগপ্রাপ্তির পর থেকে আজ অবধি তিনি যা বলেছেন তার সাথে হাবিব উল আউয়াল, হা-আউয়াল নাকি আউয়ালু হা’র সম্পর্ক বেশি তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সম্মানিত পাঠকদের ওপর ন্যস্ত করে আমি এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করতে চাই। নিবন্ধের শুরুতে বলেছিলাম, ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনে আমি একজন পর্যবেক্ষক ছিলাম এবং ২০১৮ সালের রাতের ভোটের ছিলাম ভুক্তভোগী। ফলে বিগত দু’টি নজিরবিহীন ভোটের অভিজ্ঞতা সংবলিত একজন আদমসন্তান হাবিব উল আউয়াল প্রকৃতির ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রধান নির্বাচন কমিশনার পরিচালিতব্য আগামী নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে সেটা সহজ সরল ভাষায় আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব।
শুরুতেই ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভোটারবিহীন অটো-এমপি বানানোর নির্বাচন নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। নবম পার্লামেন্টের একজন নবীন সদস্যরূপে আমি ২০১২ সাল পর্যন্ত আমার সর্বোচ্চ মেধা-মনন এবং সামর্থ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে সেবা করার চেষ্টা করেছি এবং দলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে আমার নির্বাচনী এলাকা গলাচিপা-দশমিনার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে সর্বোচ্চ শ্রম দিয়েছি। কিন্তু দলীয় কোন্দল-হানাহানি এবং সরকারের বিভিন্ন কর্ম বিশেষত দুর্নীতিবাজ-রাজনীতিবিদ-আমলাদের দৌরাত্ম্যের কারণে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। আমার হতাশা এবং দুর্নীতির সাগরচুরির বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারার বেদনার কারণে আমি রাজনীতির প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলি।
২০১৩ সালে আমি চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হই এবং তাদের প্ররোচনায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের চক্ষুশূলে পরিণত হই। আমাকে ঘায়েল করার জন্য মদ-জুয়া-নারী-অর্থ-পদ-পদবি ইত্যাদি বহুমুখী চক্রান্তের জাল ফেলা হয়। মহান আল্লাহর দয়ায় আমি সব চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে যখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন চক্রান্তকারীরা আমার বিষয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে একদা আমার জন্য জেলে যাওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং আমার কাছে তা সার্বিক বিবেচনায় নিরাপদ বলে মনে হয়। ২০১৩ সালের কোন দিনে জেলে গিয়েছিলাম বা কবে বের হয়েছিলাম তা আজ আর মনে নেই। তবে সেবার আমি যে মোট ৪৯ দিন জেল খেটেছিলাম তা মনে আছে। যেদিন জেল থেকে বের হলাম সেদিন সংসদ অধিবেশন চলছিল। জেলগেট থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠামাত্র সংসদে আমার বন্ধু-বান্ধবময় মুরুব্বিদের অনেকেই ক্রমাগত ফোন দিতে থাকলেন। তাদের সবাই সরাসরি সংসদে যোগদানের অনুরোধ জানালেন। আমি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বাসায় এলাম এবং দুপুরের খাবার খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠে সংসদে যাওয়ার কথা মনে হওয়ামাত্র একটি দৃশ্য আমার কল্পনায় এলো। রাজনীতির প্রথা অনুযায়ী সংসদে গিয়ে আমাকে দলীয় প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। আমার সঙ্গে অনেকেই যাবেন এবং সেই সাক্ষাৎপর্বে অনেক দর্শক থাকবে। প্রথানুযায়ী আমাকে অবনত মস্তকে প্রধানমন্ত্রীর পা ধরে সালাম করতে হবে এবং নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজ মুখে ক্ষমা চাইতে হবে নতুবা আমার বন্ধুরা আমার পক্ষে সমস্বরে বলে উঠবেন- আপা রনি ভুল করেছে। মাফ করে দেন!
উল্লিখিত দৃশ্য মনে হওয়ামাত্র আমার মনে কিংবদন্তির মিসরীয় বিপ্লবী সাইয়েদ কুতুব এবং তৎকালীন মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসেরের কাহিনী মনে পড়ল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সংসদে যাবো না। আমার সংসদ সদস্য পরিচয়পত্র, গাড়ির স্টিকার সব ফেলে দিলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেবো না। আমার এই সিদ্ধান্তের পর আরো ৯-১০ মাস সংসদ কার্যকর ছিল। কিন্তু আমি সংসদে যাওয়া তো দূরের কথা সংসদ ভবন দেখা যায় এমন সব রাস্তা দিয়ে চলাফেরা পর্যন্ত করিনি। আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে বাকি জীবন কাটানোর প্রত্যয় নিয়ে সাধারণ জীবনযাপন আরম্ভ করলাম। দশম সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে এলো ততই দেশের রাজপথ গরম হতে থাকল। আমি অনুমান করলাম যদি সুষ্ঠু ভোট হয় তবে আওয়ামী লীগ ৩০-৩৫টির বেশি আসন পাবে না। এ অবস্থায় এই দলের একজন সংসদ সদস্য হিসেবে ভবিষ্যতে আমার ওপর কি রাজনৈতিক বিপর্যয় হতে পারে তা হিসাব করে মন শক্ত করতে থাকলাম।
দশম সংসদ নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পর পুরো দেশ রীতিমতো অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়ল। ঢাকার রাজপথে কোনো গাড়ি ঘোড়া চলছিল না। আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিলো এবং কথাবার্তায় বেশ নমনীয় এবং কৌশলী হয়ে পড়ল। তারা দশমুখে প্রচার করল যে, এটা একটা নিয়মরক্ষার নির্বাচন এবং অতীতকালে বিএনপির ১৫ ফেব্রুয়ারির নিয়মরক্ষার নির্বাচন যেমন হয়েছিল ঠিক তেমনভাবেই এই নির্বাচনটি হবে। বিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করল না।
তারা রাজপথের চাপ ক্রমাগত বাড়াতে থাকল এবং নিজেদের বিজয়ের ব্যাপারে অতিমাত্রায় আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে পড়ল। এ অবস্থায় একটা নজিরবিহীন বিনা ভোটের নির্বাচন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পয়দা হয়ে যাওয়া এবং নির্বাচন-পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের দূতিয়ালি সম্পর্কে সামান্য পূর্বানুমান অথবা পরিস্থিতি বিশ্লেষণের চেষ্টা বিএনপি করেনি। ফলে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল অবধি টানা পাঁচ বছর ধরে দেশের সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত ৮০ ভাগ মানুষ চরম মনোবেদনা হতাশা উত্তেজনা এবং নানারকম বিভ্রান্তি ও ভেলকিবাজি দ্বারা নিজেদের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি ক্ষমতা হারাতে হারাতে প্রায় মেরুদণ্ডহীন অরাজনৈতিক প্রাণীতে পরিণত হলো।
২০১২-১৩ সালে এবং ২০১৪ সালে এই দেশের কোন মানুষ যেমন কল্পনা করতে পারেনি যে, ভোটের নামে বিনা ভোট বা অটোভোট হতে পারে অথবা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফল হতে পারে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা তদ্রুপ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখ সকালবেলা পর্যন্ত মানুষ কল্পনা করতে পারেনি যে, মহাকালের গণতন্ত্র এবং ভোটের ইতিহাসে অথবা ভোটের ডিকশনারিতে রাতের ভোট নামক শব্দ সংযুক্ত হতে পারে। মানুষ যখন প্রথম শুনেছিল যে, সারা বাংলাদেশের সব নির্বাচনী এলাকায় প্রায় একই সময়ে সব ভোটকেন্দ্রে প্রায় একই কায়দায় রাতের কর্ম করে ফেলা হয়েছে তখন বিস্ময়ে সবাই মাজনুন হয়ে পড়েছিল। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাতের বেলায় গণহারে সারা বাংলায় যে দুষ্কর্ম হয়েছিল তার কার্যকারণ, নেপথ্যের কাহিনী, লেনদেন, সে রাতের পুতুল খেলার পরিচালক-শিল্পী, কলাকুশলীদের সম্পর্কে এখন পর্যন্ত দেশের মানুষ বিস্তারিত জানেন না।
উল্লিখিত অবস্থায় নয়া সিইসি যদি অনাগত দিনে চমক দিতে চান তবে তাকে এমন কিছু করতে হবে যা এ দেশের মানুষ বর্তমানকালে তো দূরের কথা অনাগত দিনে যদি তার অধীনে কোনো জাতীয় নির্বাচন হয় তবে সেই নির্বাচনের পরের দিন থেকে দুনিয়ার শেষ দিন পর্যন্তও মানুষ অবাক হয়ে ভাববে এটা তিনি কিভাবে করলেন। তিনি যদি তার নিয়োগকর্তা হিসেবে আওয়ামী লীগকে ভাবেন তবে তার কর্ম হবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের কর্ম থেকেও জটিল-কুটিল এবং রহস্যজনক। আর তিনি যদি মহান আল্লাহর অন্যতম গুণবাচক নাম আল আউয়ালের মর্মার্থ হৃদয়ে ধারণ করে নিজের আউয়াল নামের শুকরিয়া আদায় করতে চান এবং তিনি যদি বিশ্বাস করেন যে মহান আল্লাহর দয়ায় তিনি সিইসি পদ পেয়েছেন তবে তার হেকমতের দরজা খুলে যাবে। তার মন-মস্তিষ্ক এবং তার শক্তিসামর্থ্য এমন সব অলৌকিক রসায়ন লাভ করবে যার ফলে তিনি ভবিষ্যতে জাতিকে এমন একটি নির্বাচন উপহার দেবেন যা দেখে আওয়ামী লীগ কিয়ামত দিবস পর্যন্ত বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে শুধু বলতে থাকবে- এটা হলো কিভাবে।
লেখক : গোলাম মাওলা রনি, সাবেক সংসদ সদস্য