ইউক্রেনে রাশিয়ার এই অযৌক্তিক, অনৈতিক আক্রমণ একটি যুগের সমাপ্তি বলে মনে হতে পারে ঠিক যেমনটা ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের সাথে শুরু হয়েছিল। সেই শীতল যুদ্ধ পরবর্তী যুগে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি সম্বন্ধে পশ্চিমা ধারণাগুলি বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং আমেরিকান শক্তি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে সেইসময়ে আন্ডারগার্ড করেছিল। সেই সময়ে একটা অশান্তির আবহ বিরাজ করছিল, যুগোস্লাভিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে যুদ্ধের কথাই একবার চিন্তা করুন। কিন্তু এটি এমন একটি সময় ছিল যেখানে আমেরিকান শক্তি এবং উদার গণতন্ত্রের ধারণা সঠিক বলে মনে হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করছে বলে মনে হয়েছিল।
চীন ও ভারতের মতো দেশের উত্থান, ইরাক ও আফগানিস্তানের বিপর্যয় এবং পশ্চিমে আর্থিক ও গণতান্ত্রিক সংকট সহ অনেক কারণে প্যাক্স আমেরিকানার ক্ষয় হতে শুরু করে। তবে সবচেয়ে বিঘ্নিত শক্তি হল একটি সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন, যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল যে প্রতিবেশীদের উপর তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। গত এক দশক ধরে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া বিশ্বের নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে উন্মোচন করার চেষ্টা করছে। অনেক ভাষ্যকারের মতে, বর্তমান ইউক্রেন সঙ্কট প্রমাণ করে যে গণতান্ত্রিক যুগটি আসলে একটি সংক্ষিপ্ত কল্পনা ছিল। ডেভিড ব্রুকস লিখেছেন যে “ইতিহাস আবার বর্বরতার দিকে ফিরে যাচ্ছে।” রবার্ট কাগান বলেছেন যে “জঙ্গল” আবার বেড়ে উঠছে।
কিন্তু এই ধরনের হতাশাবাদ কি ন্যায়সঙ্গত?
এই সংকটের কারণ কি? উত্তর খুব সহজ: একটি উন্মুক্ত, গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করার জন্য ইউক্রেনীয়দের অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা। ২০১৪ সালে প্রথমবার ইউক্রেন আক্রমণ করতে উদ্যত হয় রাশিয়া। তখন ইউক্রেন ন্যাটো সদস্যপদ চায়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি “অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি” চূড়ান্ত করার জন্য কিয়েভ সরকার (তৎকালীন একটি রাশিয়াপন্থী সরকার) প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট শেষ পর্যন্ত এই চুক্তিতে বাধা দেন। রাশিয়ার চাপে তাকে রাস্তায় ব্যাপক বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয় এবং সংসদ তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়। এটিই ইউক্রেনে পুতিনের প্রথম আক্রমণের সূত্রপাত করেছিল। পশ্চিমাপন্থী পথ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউক্রেন একা ছিল না। গত তিন দশকে, সোভিয়েত ব্লকের অংশ ছিল এমন বেশিরভাগ দেশই আরও উদার, গণতান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদী হওয়ার জন্য একে একে নিজের পথ বেছে নিয়েছে। বাল্টিক রাজ্য থেকে বুলগেরিয়া, পোল্যান্ডের মতো বড় দেশ থেকে শুরু করে মোল্দোভার মতো ক্ষুদ্র দেশ পর্যন্ত, বেশিরভাগই গণতান্ত্রিক রাজনীতির কিছু সংস্করণ এবং উন্মুক্ত, বাজার-ভিত্তিক অর্থনীতি গ্রহণ করেছে৷ হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডের মতো দেশ পিছিয়ে গেছে। কিন্তু বিস্তৃত ভাবে দেখলে ১৯৮৯ সাল থেকে পশ্চিমা মূল্যবোধের দিকে এই দেশগুলির আন্দোলন অবশ্যই উদার গণতান্ত্রিক প্রকল্পের প্রাণশক্তির একটি প্রমাণ।
পুতিনের প্রতিক্রিয়া গণতন্ত্রীকরণের এই জোয়ারকে থামানোর জন্য একটি রক্তাক্ত, নৃশংস প্রচেষ্টা। ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং এমনকি ২০২০ সাল নাগাদ বেলারুশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ায় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ। রাশিয়ার সহায়তায় তাদের বর্বরভাবে দমন করা হয়েছিল এবং এখন পুতিনে নিজের দেশকে কেবল ভয় এবং শক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পক্ষে সমর্থনকারী অনেকেই রয়েছে। তবে এর সমর্থনে সবচেয়ে বাকপটু বিবৃতিটি এই সপ্তাহে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেখা গিয়েছে, কোনো পশ্চিমা শক্তি নয়, বরং জাতিসংঘে কেনিয়ার রাষ্ট্রদূত মার্টিন কিমানি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি। তিনি বলেছিলেন যে আফ্রিকার প্রায় সমস্ত দেশের সীমান্ত গভীরভাবে ত্রুটিযুক্ত। ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা পরিচালিত তাই জাতিগত এবং ভাষাগত গোষ্ঠীবিভাজন সেখানে প্রত্যক্ষ করা যায়। কিমানি উল্লেখ করেছিলেন যে, আফ্রিকান নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা তাদের অসম্পূর্ণ সীমানা নিয়েই বাস করবেন, কারণ নয়তো তাদের যুদ্ধের মুখে পড়তে হতে পারে। পরিবর্তে, এই দেশগুলি আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের ব্যবস্থাকে সম্মান করার পথকেই সঠিক বলে মনে করেছে।
ইউরোপ থেকে অনেক দূরে, চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে সমস্যার মূলে কী আছে? এটি সত্য যে তাইওয়ানের জনগণ একটি উন্মুক্ত, উদার সমাজে বাস করতে চায় এবং তারা ভয় পান যে তাদের জীবনযাত্রা একটি কমিউনিস্ট একনায়কত্ব দ্বারা ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। “উদারহীন গণতন্ত্র”-এর উত্থান প্রায় গত ২৫ বছর ধরে লক্ষ করছে বিশ্ব এবং বিশেষ করে রাশিয়া (অন্যান্য দেশগুলির মধ্যে) যে একটু অন্যদিকে বাঁক নিচ্ছে তা নজর এড়ায়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে উদার গণতন্ত্র এবং নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা দরকার দৃঢ়ভাবে, এমনকি আক্রমণাত্মকভাবে। জাতীয়তাবাদ এবং জনতাবাদের কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে উদারনৈতিক মূল্যবোধগুলিকে ছাপিয়ে যায়। যারা উদার গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে তার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের ইউক্রেনে চলে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন লেখক ফরিদ জাকারিয়া। ইউক্রেনের জনগণ আমাদের দেখাচ্ছে যে তাদের মূল্যবোধগুলি কতটা দৃঢ় একটি মুক্ত সমাজ এবং একটি মুক্ত বিশ্ব গড়ার জন্য। এমনকি এর জন্য তারা মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। আমাদের সবার মনেই একটি প্রশ্ন ওঠা উচিত, তাদের সাহায্য করার জন্য আমরা কী করছি?
কলমে: ফরিদ জাকারিয়া
অনুবাদে: সেবন্তী ভট্টাচার্য্য