ঢাকা: চিনি আমদানিতে শুল্ক কমানোর সরকারি নির্দেশনাও (সময়সীমা) শেষ হচ্ছে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ এর পর থেকে আবার ৩০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্যটি আমদানি করতে হবে।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট ও জলবায়ুসহ বিরুপ আবহাওয়া ও করোনার প্রভাব ও সম্প্রতি সময়ে জাহাজ ভাড়া কয়েকগুণ বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির উৎপাদন ও দাম উর্ধ্বমুখির দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পণ্যটি আমদানিতে পুনরায় ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশে চিনি পরিশোধনকারী মিল মালিকদের সংগঠন সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংস্থাটি সরকারকে জানিয়েছে, চিনি আমদানিতে তাদের যে কর সুবিধা দেওয়া হচ্ছে এর মেয়াদ না বাড়ালে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বাজার সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, চিনির ওপর আরোপিত শুল্ক সুবিধা না বাড়ালে আগামী রোজায় চিনির দাম সেঞ্চুরি (১০০ টাকা) পার হয়ে যাবে।
জানা গেছে, ফিলিপাইনে বৈরী আবহাওয়ায় চিনির উৎপাদন কমে যাওয়ায় সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। এ সংকট কাটাতেই মূলত অতিরিক্ত চিনি আমদানির পরিকল্পনা করছে দেশটি। খবর ব্যাংকক পোস্ট। ফিলিপাইন উৎপাদনের মাধ্যমেই সাধারণত চিনির চাহিদা পূরণ করে। তবে যখন প্রয়োজন পড়ে তখন দেশটি থাইল্যান্ড ও ব্রাজিল থেকে আমদানি করে। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে দেশটির ২০২১-২২ মৌসুমের চিনি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে দুই লাখ টন পরিশোধিত চিনি আমদানির লক্ষ্য রয়েছে ফিলিপাইনের। চলতি মৌসুমে ২০ লাখ ৯৯ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল ফিলিপাইন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের পর লক্ষ্যমাত্রা ২০ লাখ ৭২ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ববাজারে চিনির ঘাটতি বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পণ্যটির দাম। ঊর্ধ্বমুখী দামে লাগাম টানতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ফিলিপাইন সরকার।
এদিকে চলতি মৌসুমে ভয়াবহ ঘাটতি থাকলেও আগামী বিপণন মৌসুমে চিনির বৈশ্বিক ঘাটতি বড় ব্যবধানে কমার পূর্বাভাস মিলেছে। ব্রাজিল ও থাইল্যান্ডে ইতিবাচক উৎপাদন পরিস্থিতি ঘাটতি কমাতে সহায়তা করছে। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ পূর্বাভাস দিয়েছে বাজারবিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান গ্রিন পুল। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০২২-২৩ বিপণন মৌসুমে চিনির বৈশ্বিক ঘাটতি দাঁড়াবে সাত লাখ ৪২ হাজার টন।
চিনি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারের প্রভাব আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মকালকে সামনে রেখে ভোজ্যতেলের মতো চিনির বাজারও হঠাৎ করেই অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে চিনির দাম বেড়েছে মণপ্রতি ১০০ টাকা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বর্তমানে চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯৫ টাকায়। রোজায় যা ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সবমিলে আসন্ন রমজানের চিনির চাহিদা ও বাজার নিয়ন্ত্রণে শুল্কহার পুনর্র্নিধারণ জরুরি বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট মহল।
চিনি পরিশোধনকারী মিল মালিকদের দাবি, এ বছর রমজান শুরু হবে এপ্রিলে। রোজা সামনে রেখে যেন এ ট্যাক্স সুবিধা আরো বাড়ানো হয়। শুধু তাই নয়, ৩০ শতাংশ থেকে রেগুলেটরি ডিউটি কমিয়ে যেটি ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, সেটি আরো কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। তারা এ সুবিধা আগামী জুন পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে। গত ২০ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিনির শুল্ক কমানোর এ প্রস্তাবটি পাঠান অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম রহমান।
এর আগে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে গত অক্টোবরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ওই সময়ে চিনি আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ৩০ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। চিনি আমদানিতে ধার্য করা নতুন এ শুল্কহার শেষ হবে ২৮ ফেব্রুয়ারি। চিনির পুরনো শুল্কহারে ফেরত যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসা ও আসন্ন রমজানে চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগে এখন থেকেই চিনির বাজার বাড়তে শুরু করেছে। তাছাড়া গ্রীষ্ম মৌসুমে বাড়তি চাহিদার পাশাপাশি এ বছর রাষ্ট্রীয় চিনিকলে উৎপাদন ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাওয়ার কারণেও চিনির বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে কমবেশি ৮০ টাকায় এবং প্যাকেটজাত ৮৫ থেকে ৯৫ টাকায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী দেশের বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয়েছে ৭৫ থেকে ৭৮ টাকায়।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপনকান্তি ঘোষ বলেন, প্রতি বছর দেশে চিনির মোট চাহিদা ১৫ থেকে ১৭ লাখ টন। এর মধ্যে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টন চিনি আসত রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা থেকে। দেশি মিলগুলোর উৎপাদন কমতে কমতে এখন ৩০ হাজার টনে নেমেছে। এ ছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় সরকার টিসিবির মাধ্যমেও কিছু চিনি আমদানি করে। অর্থাৎ চাহিদার প্রায় ছয় থেকে সাত শতাংশ চিনির জোগান আসে সরকারিভাবে। বাকি চিনির পুরোটাই সরবরাহ করে দেশের গুটিকয় কোম্পানি। এ খাতে নতুন উদ্যোক্তাও পাওয়া যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) চিনি বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৬৮০ টাকায়। যদিও এক সপ্তাহ আগে চিনির দাম ছিল দুই হাজার ৫৮০ টাকা। ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে চিনির দাম বেড়ে মণপ্রতি দুই হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে এনবিআর চিনি আমদানিতে শুল্কহার পুনর্র্নিধারণ করে। রমজানের আগে পুরনো শুল্কহারে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কায় কিছুদিন ধরে দেশের পাইকারি বাজারগুলোয় চিনির দাম ফের বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) সূত্রে জানা গেছে, বিগত বছরের মতো এবারো সরকারি ছয়টি মিলের উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। সর্বশেষ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া মাড়াই মৌসুমে আখ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল আট লাখ টন। সেখানে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আখ পাওয়া গেছে চার লাখ ৪০ হাজার টন। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্ধেক অর্থাৎ ২৪ হাজার ২৯৬ টন উৎপাদন হয়েছে বাকি নয়টি মিলে। ১৮ ফেব্রুয়ারি চালু থাকা মিলগুলোয় সর্বশেষ দিনের মতো চিনি উৎপাদন হয়। এ বছর দেশে রেকর্ড কম পরিমাণ চিনির উৎপাদন হয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী জুনের মধ্যে সরকারি মিলের চিনির মজুদ শেষ হয়ে যাবে। উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে ডিলার ও চাষীদের চিনি সরবরাহ বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। যার কারণে আসন্ন রমজান মাসে বাড়তি চাহিদার চিনি বিক্রির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যত নিষ্ক্রিয় থাকবে সংস্থাটি।
বিএসএফআইসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি ১৫টি মিলে উৎপাদন হয়েছিল ৮২ হাজার ১৪০ টন চিনি। পরের মৌসুমে ৪৮ হাজার ১৩৩ টন হলেও চলতি মৌসুমে হয়েছে ২৪ হাজার ৪৯৬ টন। এ হিসেবে গত কয়েক বছর রাষ্ট্রীয় মিলগুলোয় চিনির উৎপাদন কমেছে তিন-চতুর্থাংশ। এতে দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটির নিজস্ব কয়েক হাজার ডিলারকে চিনি বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। যার কারণে এক সময় দেশে চিনি বাজার নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রাখা বিএসএফআইসি অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
তথ্যমতে, গত দুই বছর ধরে পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, শ্যামপুর, রংপুর, পাবনা ও কুষ্টিয়া সুগার মিলের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। চলতি মৌসুমের শুরুতে বিএসএফআইসির প্রারম্ভিক মজুদ ছিল ২৫ হাজার ৬৩৮ টন। নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া মৌসুমের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ২৪ হাজার ২৯৬ টন, বিক্রি হয়েছে ২৪ হাজার ৬০৫ টন। তবে বিক্রয় শেষে ২৫ হাজার ৩২৯ টন চিনি মজুদ থাকবে। যার মধ্যে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও মিলস রেশনের জন্য সংরক্ষিত চিনির পরিমাণ ১২ হাজার ৪৩৩ টন। বাকি চিনি প্যাকেট আকারে বিক্রি করবে খুচরা সাধারণ ক্রেতাদের জন্য।
এ প্রসঙ্গে বিএসএফআইসির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মাযহার উল হক খান বলেন, এক সময় দেশের সরকারি মিলগুলোয় চিনি উৎপাদন দেড় লাখ টনের বেশি ছিল। চাহিদামতো পর্যাপ্ত আখ না পাওয়া, চাষীদের বকেয়া পাওনাসহ গত দুই বছর ছয়টি মিল বন্ধ থাকায় সরকারি চিনির উৎপাদন কমে এসেছে। যার কারণে দেশব্যাপী ডিলার পর্যায়ে চিনি সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না। তবে চাহিদা থাকায় প্যাকেটজাত এক কেজির মোড়কে চিনি ও সংরক্ষিত খাতের চিনি সরবরাহ অব্যাহত রাখা হয়েছে।