পানি ছাড়া জীবন চলে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু খাল-বিল-নদীর দেশে দাম চড়ছে পানির। দফায় দফায় বাড়ছে অন্য তিনটি পণ্যের দামও। ধীরে ধীরে এসব যেন চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অতি প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম গত ১২ বছরে বেড়েছে দুই থেকে আড়াই গুণ। দুর্বিষহ জীবনে পড়েছেন শ্রমিক, কৃষক, চাকরিজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ। বিনোদন, চিকিৎসা, লেখাপড়া এমনকি খাওয়ার খরচ কমিয়ে তারা চাপ সামলাচ্ছেন। সব দিকে কাটছাঁট করে শুধু প্রাণটুকু বাঁচিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন দিন। নতুন করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা যেন তাদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে
চাকরিতে বদলি হওয়ায় সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর থেকে মগবাজারে বাসা নিয়েছেন বজলুর রহমান। নতুন বাসায় লাইনের গ্যাস নেই। তাই এলপিজি ব্যবহার করেন তিনি। মাসে ১২ কেজির দুই সিলিন্ডার গ্যাস লাগে। জানুয়ারি মাসে দুই সিলিন্ডার কিনতে তার খরচ হয়েছে আড়াই হাজার টাকা। যদিও সরকার নির্ধারিত দাম ছিল দুই হাজার ৩৫৬ টাকা (প্রতি সিলিন্ডার ১১৭৮ টাকা)। চলতি মাসেই সিলিন্ডারপ্রতি ৬২ টাকা দাম বাড়িয়েছে সরকার। দোকানে দাম আরও বেশি রাখছে। শুধু রান্নার গ্যাসেই গত মাসের চেয়ে তার ১৫০ টাকা বেশি খরচ হবে।
বজলুর রহমান বলেন, সব জিনিসের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। কিন্তু করোনার কারণে গত দুই বছর বেতন বাড়েনি। প্রতি মাসে এখন ধারদেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দামও বাড়বে। এভাবে সবকিছুর দাম বাড়তে থাকলে জীবন চলবে কী করে?
শুধু এলপিজি নয়, গত ১১ বছরে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে সরকারি গ্যাসের দাম। ২০০৯ সালে দুই চুলার গ্যাসের মাসিক বিল ছিল ৪০০ টাকা। পাঁচ দফায় বেড়ে তা হয়েছে ৯৭৫ টাকা। বৃদ্ধির হার ১৪৩.৭৫ শতাংশ। চলতি মাসে নতুন করে দুই চুলার গ্যাসের বিল ২১০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। ২০০৯ সালে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের খুচরা দাম ছিল চার টাকা ৩৪ পয়সা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯ টাকা ৯৬ পয়সা, বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। চলতি মাসে এই দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছে পেট্রোবাংলা।
বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকার আরও এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। গত ১১ বছরে সরকার ১০ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ। ২০১০ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় খুচরা মূল্য ছিল তিন টাকা ৭৬ পয়সা। সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চে তা বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়। এখন আরেক দফা দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপে সম্প্রতি জানানো হয়, দেশে করোনাকালে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ জনজীবনকে স্থবির করে দেবে। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি কৃষি, পরিবহন, দ্রব্যমূল্য, শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। থমকে যায় অর্থনীতির অগ্রযাত্রা। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বড় ধরনের দুর্যোগ দেখা দেবে। মূল্যবৃদ্ধির নিচে চাপা পড়া জনগণের জন্য তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দেবে।
ঢাকার দক্ষিণ মুগদার বাসিন্দা রাহেলা বেগম কাজ করেন বাসাবাড়িতে। তিন বাসায় কাজ করে মাসে আট হাজার টাকা আসে। এর মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা চলে যায় ঘর ভাড়ায়। বাকি টাকা দুই সন্তানসহ চলতে হয় সারা মাস। তিনি বলেন, কয়েক ঘরের একটি চুলা। ভোরে উঠেই লাইন দিতে হয়। কিন্তু সকাল ৭টার পরই লাইনে গ্যাস থাকে না। তখন কেরোসিনের চুলায় রান্না করতে হয়। কিন্তু মাস শেষে মালিক ঠিকই গ্যাসের জন্য টাকা নিচ্ছেন। এতে মাসের খরচ আরও বেশি হচ্ছে।
তিনি বলেন, শুনছি গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নাকি আরও বাড়বে। এখন যা কামাই হয় তাতে তরিতরকারিই ঠিকমতো কিনতে পারি না। সব কিছুর দাম বেশি। এরপর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে না খেয়ে থাকতে হবে।
লোকসান কমাতে দাম বৃদ্ধির কথা বলা হলেও, গ্যাস ও বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই লাভজনক। তারা প্রতি বছর সরকারি কোষাগারে কয়েক হাজার কোটি টাকা জমা দিচ্ছে। উদ্বৃত্ত অর্থ, ট্যাক্স-ভ্যাট ও বিভিন্ন ফি হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত থেকে আয় করেছে সরকার। গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দিয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাসও বাড়ছে ফি বছর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যয় বাড়ছে দিন দিন। চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হওয়ায় বসিয়ে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নজর না দিয়ে গ্যাস আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এতেও বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে সরকারের। খাত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম-অব্যস্থাপনা দূর না করে, বাস্তবাসম্মত পরিকল্পনা না নিয়ে দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ মূলত সরকারের ব্যর্থতার দায় জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার নামান্তর।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গ্যাস সংকট জিইয়ে রেখে এলএনজির ব্যবসার দ্বার খোলা হয়েছে। সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যবসার মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভরছেন। এটা স্পষ্ট যে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের লোকসান আসলে সংশ্নিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বশীলদের অব্যবস্থাপনা, অবহেলা আর দুর্নীতির ফল। কিন্তু এর দায় মেটাতে হচ্ছে জনগণকে।