দীর্ঘদিন পর ছোট্ট একটা কাজে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বাসায় গিয়েছিলাম। আমার পিএস ফরিদ আহমেদের লেখা ‘বঙ্গবীরের ভারতে নির্বাসনের দিনগুলি’ তাঁর হাতে দিতেই তিনি বললেন, ‘আমরাও একটা বই বের করেছি’ বলেই ‘নেতা মোদের শেখ মুজিব’ আমার হাতে তুলে দিলেন। চমৎকার একটি বই। বইটির ওপর আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। আলোচনায় হাতও দিয়েছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে বজ্রপাতের মতো ভেসে এলো আমার পরম স্নেহের, শক্তিশালী কলামিস্ট, সাহসী সাংবাদিক পীর হাবিবের মৃত্যুসংবাদ। মৃত্যু শাশ্বত সত্য। জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে। সব জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। বয়স হয়েছে তাই জানি মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবু কিছু কিছু মৃত্যু কাউকে কাউকে উতালা করে তোলে। চিন্তার মধ্যে যখন থাকে না তখন মৃত্যু এসে হানা দেয় তখন বুকের নিভৃত কোণে আঘাত হানে, রক্তক্ষরণ হয়। পীর হাবিবের মৃত্যুটা আমার কাছে অনেকটাই সে রকম বেদনাদায়ক। কিছুদিন আগে ক্যান্সারের চিকিৎসায় ভারতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পর এ দুই-পৌনে দুই বছর কথা হয়েছে অনেকবার, কিন্তু দেখা হয়নি একবারও। আমাদের পরিবারে আমরা দুজন বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী, তাঁকে সবাই দাদা বলে, আমাকে বলে ছোট ভাই। আমাদের পরিবারে দাদা আর ছোট ভাই এ দুটি সম্বোধনই প্রচলিত। অনেকে ছোট ভাই বলায় আমি ছোট কি না এমন প্রশ্নও করে অনেকে। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়। লতিফ ভাইয়ের পর আরও দুই ভাইবোন ছিলেন। তাঁরা ষাটের দশকের আগেই চলে গেছেন। তাই আমার আর লতিফ ভাইয়ের মাঝে পর্দা হিসেবে কেউ নেই। ফলে আমরা একজন দাদা, আরেকজন ছোট ভাই। ’৯০-এ দেশে ফেরার পর কিছু তরুণ সাংবাদিকের সঙ্গে মেলামেশা, ওঠাবসা হয়। তাদের মধ্যে পীর হাবিব একজন। নঈম নিজাম, বোরহান কবীর, পীর হাবিব, শেখ মামুন, শাহেদ চৌধুরী, নূরুল কবীর, সালেম সুলেরী, সেলিম সামাদ, আশরাফ আলী, মুরাদুজ্জামান মুরাদ, শাবান মাহমুদ, স্বদেশ রায়, আলমগীর রহমান, পাভেল রহমান, ইরতিজা নাসিম আলী এ রকম ১০-১৫ জন দাদা বলে ডাকে। ফোন ধরতেই ‘দাদা’ বলে তাদের সাড়া দেওয়ায় মন ভরে যায়। পীর হাবিবের কলম চলত বুলেট ট্রেনের মতো। লেখায় দারুণ শক্তি। আমি যেমন বঙ্গবন্ধু পাগল, পীর হাবিব ছিল বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্ধ ভক্ত-অনুরক্ত। খুব সূক্ষ্মভাবে সবকিছু দেখা পীর হাবিবের সহজাত স্বভাব ছিল। পীর হাবিবের লেখার সঙ্গে কোনো কোনো সময় একমত হতে না পারলে, আমার লেখায় ভিন্নমত ফুটে ওঠলে যেটা সংশোধনের প্রয়োজন হতো সেটা এতটা সুন্দর সহজভাবে সংশোধন করে নিত যা বলার মতো নয়। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী সম্পর্কে পীর হাবিব আর আমার মত এক ধারায় প্রবাহিত হতো না। কোনো কোনো নেতানেত্রী সম্পর্কে আমি যখন ভিন্নমত পোষণ করেছি অবলীলায় যেটা মানার সেটা মেনে নিত। মতিয়া চৌধুরীর প্রতি পীর হাবিবের একটা সূক্ষ্ম দুর্বলতা ছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে কথা হওয়ার পর আমার কিছু কিছু লেখা পড়ার পর তার ধারণা পাল্টে গিয়েছিল। ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ সম্পর্কে একসময় তার কিছুটা খুঁতখুঁতনি ছিল। কিন্তু আমি যখন বলেছি সবাই সব সময় সফলতা পায় না। একজনের কাছে সবকিছু প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা কিয়ামত পর্যন্ত স্মরণ করার মতো। সে সময় আমরা ওভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়লে, একটা গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে না পারলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেতেন না, আজকের বাংলাদেশও হতো না। দুষ্ট লোকেরা বলবার চেষ্টা করেছে, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তোফায়েল আহমেদ রক্ষীবাহিনীকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেননি বা করেননি। কথাটা সম্পূর্ণই মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ আঙুল চুষলেন, বিডিআর-প্রধান খলিলুর রহমান আঙুল চুষলেন, নেভি-এয়ারফোর্স-পুলিশ সবাই আঙুল চুষল, তোফায়েল আহমেদ কী করতেন? তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট করা। এটা কিছুটা খুনিরা করেছে, কিছুটা আওয়ামী লীগ করেছে। বৈতরণী পার হলে বা আমেরিকার স্বার্থ হাসিল হলে তাঁকে ছুড়ে ফেলতে আমেরিকার আর এক মুহূর্ত লাগে না। ঠিক তেমনি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ। তাদের বাইরের শত্রুর খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। সে কারণে তোফায়েল আহমেদকে ছোট করার চেষ্টা হয়েছে, এখনো তা বহাল আছে। তোফায়েল আহমেদ সম্পর্কে আমার লেখা এবং কথাবার্তায় তার খুঁতখুঁতনি ষোল আনা কেটে যায়। অন্যদিকে বেগম মতিয়া চৌধুরী সম্পর্কে পীর হাবিবের বেশ কিছুটা দুর্বলতা ছিল। বঙ্গবন্ধুর পিঠের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চাওয়ার কথা আমি তুলে ধরলে তার প্রতি যে সহমর্মিতা ছিল তা-ও কেটে যায়। পীর হাবিবের সব থেকে বড় গুণ ছিল যুক্তিযুক্ত যে কোনো কথা খুব সহজে গ্রহণ করা। কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না। দুই হাতে অর্থবিত্ত সংগ্রহ করতে হবে এমন খায়েশও ছিল না। মাত্র আট বছর আগে পীর হাবিবের অর্ধশত বর্ষ পালনে গুলশান ক্লাবে এক অনুষ্ঠান হয়েছিল। তাতে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী তাঁর মধ্যে জননেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, হাসানুল হক ইনু, খুব সম্ভবত রাশেদ খান মেনন আরও বেশ কজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী গিয়েছিলেন। ভারতের হাইকমিশনার, অভিনেত্রী তিশা এমনকি জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর স্ত্রী টাঙ্গাইলর গোপালপুরের মেয়ে মুন্নী, আরও অনেকেই হাজির হয়েছিলেন। বড় যত্ন করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি খুব খুশি এবং অবাক হয়েছিলাম এত বড় বড় মানুষ একত্র হওয়ায়। ’৯০-এ দেশে ফিরে কবে কখন কোথায় পীর হাবিবকে প্রথম দেখেছিলাম জানি না। খুব সম্ভবত আজকের কাগজে নঈম নিজাম, বোরহান কবীর, শাহেদ চৌধুরী আরও কাকে যেন পেয়েছিলাম। শেখ মামুন, আশরাফ আরও দু-এক জনের সঙ্গে সে সময়ই পরিচয় হয়। তারা তখন যেমন ভালোবাসত, এখনো একই রকম ভালোবাসে, সম্মান করে। কোনো কাজের কথা বললে পাগলের মতো ছোটাছুটি করে করে দেয়। মনে হয় রসুনের কোয়া খসে গেল বা ঝরে গেল। আল্লাহ জানেন এরপর কী হবে। সে সময়ের তরুণ তুর্কি লেখক-সাংবাদিকের মধ্যে অনেকেই দেশের বাইরে চলে গেছে। তার মধ্যে সালেম সুলেরী, মুরাদুজ্জামান মুরাদ। পীর হাবিব এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। মৃত্যু এমন একটি বিষয় যে কাউকে বলে-কয়ে আসে না। তার যখন ইচ্ছা হয় তখনই আসে। কারও অনুমতির ধার ধারে না। আজ ১২-১৩ বছর যাবৎ নিয়মিত লিখি। পত্রিকা ছাড়াও এখানে ওখানে কমবেশি লেখা দিতে হয়। আনন্দের সঙ্গেই লেখা দিই। বাংলাদেশ প্রতিদিনের যখন শুরু হয় তখন অফিস ছিল মগবাজারে। সেখানে একদিন গিয়েছিলাম। বসেছিলাম নঈম নিজামের ঘরে। তখন নঈম নিজাম ছিল ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। শাহজাহান সরদার সম্পাদক। নঈম নিজাম এবং আরও কয়েকজন জোর করে আমাকে লেখক বানিয়েছে। আগে লিখতে ক্লান্তি আসত। এখন না লিখলে মন উশখুশ করে, অস্বস্তি লাগে। একজন পাঠক যখন লেখা পড়ে সমালোচনা করে তখন বড় ভালো লাগে। অনেকে শুধু ভালোই শুনতে চায়। আমার তেমন বাতিক নেই। আমি একসময় ছিলাম মহাত্মা গান্ধীবিদ্বেষী, নেতাজি সুভাষ বোসের অনুরক্ত-ভক্ত। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে মায়ের মতো ভালোবাসলেও তাঁর বাবা পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে ভালো বাসতাম না। কারণ একটাই- মহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত নেহরু নেতাজি সুভাষ বোসের বিরোধিতা করেছেন। পরে বড় হয়ে পন্ডিত নেহরু, মহাত্মা গান্ধীকে পড়ে আমার মনে হয়েছে যাঁর যাঁর দিক থেকে তাঁরা সবাই ঠিক। একতরফা অন্ধ ভালোবাসা বা সমর্থন কোনোটাই ঠিক নয়। চরম দ্বন্দ্বের সময় মহাত্মা গান্ধীকে এক বিদেশি সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কাকে কতটা বিশ্বাস করেন, ভালোবাসেন- নেহরু না সুভাষ বোস? মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, আমি এক গ্লাস পানিতে বিষ মিশিয়ে সুভাষ বোসের সামনে ধরলে কোনো প্রশ্ন না করে পান করে নেবে, নেহরুর সামনে ধরলে সে জিজ্ঞেস করবে, বাপুজি এতে কী আছে? ‘বিষ’ শোনার পর নেহরুও তা পান করবে এটুকু পার্থক্য। একজন জিজ্ঞেস না করেই পান করবে, আরেকজন বিষ জেনেও পান করবে। এ থেকে আমি শিক্ষা নিয়েছিলাম শুধু একজনকে ভালোবাসতে গিয়ে আরেকজনকে খারাপ বলা, ঘৃণা করা কোনো জ্ঞানের কথা নয়। স্বাধীনতার পরপরই কমান্ডার আবদুস সবুর খান বীরবিক্রম আমাকে এক বিচারসভায় নিয়ে গিয়েছিল। কেবলই দেশ স্বাধীন হয়েছে। যেখানেই যাই হাজারো মানুষের ভিড়। সেখানেও তেমন হয়েছিল। অনেক বলে-কয়ে লোকজনকে শান্ত করা গেলে এক মাদবর বললেন, জ্ঞানহীন মূর্খের শ্রমের মজুরি যেখানে ১ টাকা, সে যদি লেখাপড়া জানে তাহলে সেই শ্রমে ১০০ টাকা আর জ্ঞানী হলে লাখ লাখ। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, লেখাপড়া করলেই কেউ জ্ঞানী হয় না। লেখাপড়া না জানলে যে শ্রমে ১ টাকা উপার্জন করা যায়, লেখাপড়া থাকলে সেই একই শ্রমে হয়তো শত টাকা উপার্জন করা যায়। আর সে যদি জ্ঞানী হয় তার যদি লেখাপড়া থাকে তাহলে একই পরিশ্রমে সে কত টাকা উপার্জন করবে তা বলে-কয়ে শেষ করা যাবে না। সেজন্যই প্রবাদ আছে- অজ্ঞান মূর্খ বন্ধুর চাইতে জ্ঞানী শত্রু অনেক ভালো। আমি এটা বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের তেমন স্কুলের লেখাপড়া ছিল না। কিন্তু তিনি ভারতবর্ষের এক শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ছিলেন। বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তাঁর লেখাপড়াও ম্যাট্রিক পর্যন্ত নয়। আসানসোলে এক রুটির দোকানে কাজ করার সময় ত্রিশালের এক পুলিশ অফিসার তাঁকে আসানসোল থেকে নিয়ে এসেছিলেন। ত্রিশালে তিনি নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। তারপর আর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো স্কুল-কলেজ মারাননি। অথচ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের লেখা পৃথিবীর কত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় তার লেখাজোখা নেই। জ্ঞানের ভান্ডার ছিলেন হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাঁর লেখাপড়াও আমপাড়া পর্যন্ত। কিন্তু তিনি দেওবন্দে গেছেন, তিনি মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে এসেছেন। তাই জ্ঞান আর বিদ্যা, জ্ঞান আর অবিদ্যা এক নয়। কদিন আগে হঠাৎই একজনের একটি চিঠি পেয়েছিলাম। কোনো মানুষকে যত রকম তাচ্ছিল্য করা যায় তার চাইতে অনেক বেশি করেছেন। আমার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন-যৌবন বিসর্জন এসব কোনো গোনতায়ই ধরেননি। চিঠি পড়ে উত্তর লিখেছিলাম। ঠিকানা ছিল ‘কাজী রফিক, আটিপাড়া, মানিকগঞ্জ। পোস্ট অফিস বলেছে এতে যথাস্থানে চিঠি যাবে না। আমি ভেবেছিলাম ভারতে নির্বাসনে থাকতে অনেক চিঠি ‘টাইগার সিদ্দিকী, ইন্ডিয়া’ এটুকু লেখাতেই পেয়েছি। এখনো ‘কাদের সিদ্দিকী, বাংলাদেশ, কাদের সিদ্দিকী, টাঙ্গাইল’ এ রকম লেখায় চিঠি পাই। সাহস করে যদি ভদ্রলোক তার ঠিকানা বা ফোন নম্বর দিতেন আমি তাকে যা লিখেছি তিনি তা জানতে পারতেন।
পীর হাবিব আমাকে কতটা ভালোবাসত তা লিখে বোঝানো যাবে না। যখনই সময় সুযোগ পেত তখনই আমাকে নিয়ে লেখালেখির চেষ্টা করত। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধযুদ্ধ নিয়ে লিখতে কখনো ভুলত না। আমরা একজন সত্যিকারের সাহসী কলমযোদ্ধা হারালাম। আল্লাহ তাকে বেহেশতবাসী করুন, তার পরিবার-পরিজনকে এ শোক সইবার শক্তি দিন এবং নিরাপদে রাখুন এই কামনা করি। পীর হাবিব এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে ৫ ফেব্রুয়ারি শনিবার আর ভারত উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর ৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার। লতা মঙ্গেশকরের পরিণত বয়স হয়েছিল তাই অতটা বুকে বাধেনি। ভারতের বহু নামকরা জগদ্বিখ্যাত শিল্পীর গান সামনে বসে শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। লতা মঙ্গেশকরকে শুনেছিলাম স্বাধীনতার পরপরই ঢাকায়। চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্যসেনের অবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করার সময় সিপিএম নেতা গণেশ ঘোষসহ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, অনুপ ঘোষাল আরও অনেকেই সেদিন এসেছিলেন। দিল্লি-বিহার-কলকাতায় মান্না দে, সতীনাথ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকাসহ আরও অনেকের গান শুনেছি। খুনিদের হাতে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর সেই প্রতিরোধযুদ্ধের একপর্যায়ে শিলিগুড়িতে থাকার সময় শ্যামল মিত্র, অনুপ ঘোষাল, সতীনাথ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠান করে ফেরার পথে ট্রেন মিস করায় আমার বাড়িতে এক রাত ছিলেন। লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মোহাম্মদ রফি ও আরও বেশ কিছু শিল্পীর গান সামনাসামনি বসে শোনার সুযোগ হয়েছে। এ রকম একজন কণ্ঠশিল্পী আবার আমরা পাব কি না জানি না। সেই ছোটবেলায় যখন শুনতাম ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে/আমারই দুয়ারও প্রান্তে/সে তো হায়, মৃদু পায়,/এসেছিল পারিনি তো জানতে,’ গানটি শুনে শিহরিত হতাম। ’৬২-তে ভারত-চীন যুদ্ধের পর লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো/তুম খুব লগালো নারা/ইয়ে শুভ দিন হ্যায় হম সবকা’ গানটি এত হৃদয়স্পর্শী ছিল তাই কতবার যে সে গান গেয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। যেখানে যে অনুষ্ঠানে যেতেন সেখানে দর্শক-শ্রোতাদের কাছ থেকে অনুরোধ আসত ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো’ গানটি শুনবার জন্য। সবাই চলে যাবে। পূর্ণ বয়সে প্রত্যাশিত সময়ে কেউ চলে গেলে খুব একটা বুকে বাধে না, রক্তক্ষরণ হয় না। কিন্তু পীর হাবিবের মতো ফাঁকি দিয়ে কেউ চলে গেলে বড় যন্ত্রণা হয়, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আল্লাহ রব্বুল আলামিন পীর হাবিবকে বেহেশতবাসী এবং লতা মঙ্গেশকরকে স্বর্গবাসী করুন।
লেখক : রাজনীতিক।