বড় গ্রাহকের ৮২ শতাংশ ঋণই জামানত ছাড়া

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

ব্যাংকগুলো বরাবরই বড় বড় গ্রাহককে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। এ জন্য চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতায়ও। গ্রাহকের সক্ষমতা ও ঝুঁকি বিবেচনা না করেই নামমাত্র জামানতে বিপুল অঙ্কের ঋণ তুলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ছোটদের সহায়ক জামানত ঋণ দিতে চায় না ব্যাংকগুলো।

ঋণ বণ্টনের এই বৈষম্যে একই ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ও গ্রæপে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেন্দ্রীভ‚ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৫৫ শতাংশই বড় গ্রাহকের অনুক‚লে কেন্দ্রীভ‚ত। এর পরিমাণ ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। এসব ঋণের বিপরীতে জামানত জমা আছে মাত্র ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা বা ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ বড় গ্রাহকের প্রতি ১০০ টাকার ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর জামানত নেওয়া আছে মাত্র ১৮ টাকা। এর মানে কেন্দ্রীভ‚ত ৮২ শতাংশ ঋণই এখন জামানতবিহীন। আবার বড় গ্রাহকদের মূলধনের কয়েকগুণ বেশি অর্থায়ন করেছে ব্যাংকগুলো। বড় গ্রাহকদের বিতরণ করা ঋণের ৫০ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৫০ দশমিক ২১ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ৮২ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছে। এই ঋণ নিয়মিত করা না হলে বড় গ্রাহকদেরই খেলাপি ঋণ দাঁড়াত ১ লাখ ৩২ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সব ব্যাংকের মধ্যে শর্ট টাইমে মুনাফা করার একটা প্রবণতা কাজ করে। সে অনুযায়ী শাখা পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা বেধে দেওয়া হয়। ব্যাংক কর্মকর্তারা সে টার্গেট পূরণে বড় ও প্রতিষ্ঠিত ঋণগ্রহীতাদের পেছনে ছোটে।

এ ছাড়া বড় গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক জামানতের পরিবর্তে তাদের ব্যবসায়িক অবস্থা, প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ ফ্লো ও ব্যবসায়িক সুনাম ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত না হওয়ায় সহায়ক জামানত ছাড়া ব্যাংক ঋণ দিতে চায় না। এই প্রবণতা ব্যাংক খাতে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এই ঝুঁকি হ্রাসে ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শ দেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ বণ্টনেও বৈষম্য বাড়ছে। বড় গ্রাহকের কাছে অধিক পরিমাণ ঋণ কেন্দ্রীভ‚ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু ছোটদের কাছে ঋণ সেভাবে যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ব্যাংকে আমানত আসছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। সেটি ঋণ হিসেবে যাচ্ছে কিছুসংখ্যক ব্যক্তির কাছে। এদের দেওয়া মানে অনেকটা জিম্মি হয়ে যাওয়ার মতো। তারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতেও নানা টালবাহানা করে। এ ধরনের প্রবণতা ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি তৈরি করছে। কিন্তু ছোটদের ঋণ নিয়ে ফেরত দেওয়ার রেকর্ড ভালো। ছোটদের ঋণে খেলাপির হারও কম। তাই ব্যাংকিং খাতে ঋণঝুঁকি কমিয়ে আনতে ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শ দেন সাবেক এ গভর্নর।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্টাবিলিটি বিভাগ থেকে ৫০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব সীমার বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ২৮ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব সীমার ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৫৭ কোটি টাকা, যা এ খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ৫৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এই ঋণগুলোর বিপরীতে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলোর নেওয়া জামানতের আর্থিক মূল্য ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা, যা তাদের কাছে কেন্দ্রীভ‚ত ঋণের মাত্র ১৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। প্রতিবেদনে ২৩ ব্যাংকের ওপর বিশেষ নজর দিয়ে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৬০ শতাংশের অধিক ঋণ বড় গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভ‚ত। এর মধ্যে শীর্ষ তিনটি ব্যাংক হচ্ছে এইচএসবিসি, এনসিসি ও এক্সিম ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর যথাক্রমে ৯৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ৯৩ দশমিক ১১ শতাংশ ও ৮৪ দশমিক ০৬ শতাংশ বড় গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভ‚ত। এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কাছে জামানত আছে যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ ও ১৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, বড় গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর মধ্যে সব সময়ই প্রতিযোগিতা থাকে। এমনও দেখা যায়, গ্রাহক যে পরিমাণ ঋণ পাওয়ার যোগ্য, তার চেয়েও বেশি দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর এ অসুস্থ প্র্যাকটিসের কারণে বড় গ্রাহকরা প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়াই ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু গ্রাহকরা ঋণ ফেরত দিতে পারবে কিনা বা পরবর্তী সময়ে ঋণ কীভাবে ফেরত আসবে, সেই চিন্তা আর করা হয় না। এভাবে বড় গ্রাহকদের উদারভাবে ঋণ দেওয়ার কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তিনি বলেন, বড় গ্রাহকদের ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের শুধু পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন করে বসে থাকলে হবে না। ব্যাংকগুলো যেন ওই ঋণ আদায়ে তৎপর হয়, সেদিকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থান থাকতে হবে।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় জামানতের তুলনায় কম ঋণ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো বিধান নেই। তবে ব্যাংকগুলো নিজস্ব ঋণ নীতিমালার আলোকে জামানত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। প্রতি ১০০ টাকার ঋণের বিপরীতে ১২০ থেকে ১৫০ টাকার সমপরিমাণ জামানত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে বড় গ্রাহক ও গ্রæপের ক্ষেত্রে এ বাধ্যবাধকতা কেবল কাগজ-কলমেই। পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন বলছে, ৫০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব সীমার ঋণ বিবেচনায় ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ ঋণগ্রহীতা এস আলম গ্রæপ। ১১টি ব্যাংকে গ্রæপটির মোট ঋণ ৩১ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণদাতা ব্যাংকগুলোয় ওই গ্রæপের জামানতের আর্থিক মূল্য ৩ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা তাদের গৃহীত ঋণের মাত্র ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রæপ। এ গ্রæপটির ১১টি ব্যাংকে মোট ঋণের পরিমাণ ২০ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। ঋণদাতা ব্যাংকগুলোয় ওই গ্রæপের রাখা মোট জামানতের আর্থিক মূল্য ৪ হাজার ৭০১ কোটি টাকা, যা তাদের গৃহীত ঋণের মাত্র ২৩ দশমিক ১০ শতাংশ। এর পরই আছে বসুন্ধরা গ্রæপ। ২৫টি ব্যাংকে গ্রæপটির মোট ঋণ ১৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। ঋণদাতা ব্যাংকগুলোয় ওই গ্রæপের জামানতের আর্থিক মূল্য ৪ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা তাদের গৃহীত ঋণের ২৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ ছাড়া ক্রিসেন্ট ও থার্মেক্স গ্রæপের ব্যাংকে রাখা জামানত হার যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ ও ১০ দশমিক ১০ শতাংশ।

কম জামানত নেওয়ার পাশাপাশি শীর্ষ গ্রæপগুলোর মূলধনের কয়েকগুণ বেশি অর্থায়ন করেছে ব্যাংকগুলো। উচ্চ ঋণ-মূলধন অনুপাতসম্পন্ন গ্রæপগুলোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ ৫০টি গ্রæপের মধ্যে পাওয়ার গ্রিড ছাড়া ১৬টি গ্রæপের ঋণ-মূলধন অনুপাত ২০০ শতাংশের ওপরে। উচ্চ ঋণ-মূলধনসম্পন্ন শীর্ষ তিনটি গ্রæপ হচ্ছে ক্রিসেন্ট, থার্মেক্স এবং এস আলম গ্রæপ। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রæপের ঋণ-মূলধন অনুপাত ৮১২ শতাংশ। থার্মেক্স গ্রæপের ৫৯৬ শতাংশ। এস আলম গ্রæপের ৪৪০ শতাংশ। এ ছাড়া বসুন্ধরা গ্রæপের ২৭৬ শতাংশ ও বেক্সিমকো গ্রæপের ১৯০ শতাংশ।

বড় গ্রাহকের অনুক‚লে বিতরণ করা ঋণগুলোর বড় একটা অংশ খেলাপিও হয়ে পড়েছে। প্রতিবেদন বলছে, ৫০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব সীমার বেশি যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ কর হয়েছে তার মধ্যে ৫০ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৫০ দশমিক ২১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষে রূপালী ব্যাংক ৯৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের ৯২ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং এবি ব্যাংকের ৭৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, এইচএসবিসি, আইএফআইসি ব্যাংক ও মেঘনা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ৫০ শতাংশের অধিক ঋণ বড় গ্রাহকদের।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ৫০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব সীমার ঋণগ্রহীতাদের ৮২ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা হয়েছে। বড়দের ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের পরিমাণের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির পুনঃতফফিল ও পুনর্গঠন করা ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর পরই আছে ইসলামী ব্যাংক ৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া এবি ব্যাংক করেছে ৯ হাজার ২৫ কোটি টাকা।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আমাদের সময়ক বলেন, যে কোনো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জামানতের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ক্যাশ ফ্লো বিবেচনায় নেওয়া হয়। মূলত ঋণটা কীভাবে ফেরত আসবে বা ঋণ শোধের ম্যাকানিজম হিসেবে ক্যাশ ফ্লো আছে কিনা, সেটি দেখা হয়। এর পর ওই ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সহায়ক জামানত নেওয়া হয়। তবে সহায়ক জামানতের বিষয়টি যাদের আমি চিনি না, তাদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য হয়। আবার বড়দের সবাই ঋণ দিতে এতটাই আগ্রহী থাকে যে, সহায়ক জামানত চাওয়ার সুযোগও থাকে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *