সংঘাত, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির মধ্য দিয়েই শেষ হলো দশম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। ছয়জন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল ভোটের প্রথম ধাপ। গতকাল সোমবার সপ্তম ধাপে ১৩৬ ইউপির ভোটে দু’জন নিহত হয়েছেন। প্রাণহানি ছাড়াও অনিয়ম, বিনা ভোটে জয়সহ নানা নেতিবাচক উদাহরণ তৈরি করেছে এবারের ইউপি ভোট। চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হলেও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এই ভোটে প্রতীক বরাদ্দ দেয়নি। তবু কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়েছে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের। বিনা ভোটের জয় বাদ দিলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন ৪৪ শতাংশ ইউপিতে। অনেক স্থানেই নিজ দলের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে তাদের নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে। আবার কোথাও জামানত রক্ষার মতো নূ্যনতম ভোট পাননি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা।
সারাদেশে মোট ইউপির সংখ্যা চার হাজার ৫৭৪টি। এর মধ্যে চার হাজার ১৩৮টিতে নির্বাচন হয়েছে। মামলা ও সীমানা জটিলতা থাকায় ৪৩৬টি ইউপিতে তপশিল ঘোষণা করা হয়নি।
গতকাল ভোট শেষে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, নির্বাচনে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনী সহিংসতায় দু’জন নিহত হয়েছেন। ছয়টি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে।
গতকাল শেষ ধাপে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৩১টি ইউপির ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ১৬টিতে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ১৪টিতে। একটিতে জিতেছেন সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রার্থী। স্বতন্ত্রদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী রয়েছেন তিনজন, বিএনপির স্থানীয় নেতা রয়েছেন চারজন এবং দলীয় পরিচয়হীন রয়েছেন সাতজন।
এর আগের ছয় ধাপে ভোট হওয়া ইউপিগুলোর মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জিতেছেন এক হাজার ৭৬১টি ইউপির চেয়ারম্যান পদে। আর প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় একক প্রার্থী হিসেবে বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন ৩৭১ জন। বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন এক হাজার ৬৯২টিতে। পুরো ভোটে একটি মাত্র ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। বিজয়ী স্বতন্ত্রদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের পদ-পদবিধারী নেতারা রয়েছেন।
নির্বাচনী সহিংসতার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ স্থানে নৌকার সমর্থকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউপি ভোটের সহিংসতায় ১১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সমকালের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, গতকাল পর্যন্ত প্রাণহানি ১৪০ জনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ভোটের দিন প্রথম ধাপে (দুই পর্বে) ছয়জন, দ্বিতীয় ধাপে ২৮ জন, তৃতীয় ধাপে ২৬ জন, চতুর্থ ধাপে ৯ জন, পঞ্চম ধাপে ২০ জন, ষষ্ঠ ধাপে দু’জন এবং সপ্তম ধাপে গতকাল দু’জন নিহত হয়েছেন। বাকিরা নির্বাচনী প্রচারকালে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন। ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতেও কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে।
বিশ্নেষকদের মতে, তৃণমূল রাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্তরের ভোট উৎসব এবার ম্লান হয়ে গেছে নির্বাচনী সহিংসতায়। শুরু থেকেই নির্বাচনী কার্যক্রমের সঙ্গে শুরু হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। ১০ ফেব্রুয়ারি আরও আটটি ইউপিতে ভোট হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রতিটি ধাপেই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ নানা অনিয়মের খবর মিলেছে। এসব অনিয়ম ও সহিংসতা রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি। অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন, এসব অনিয়ম ও সহিংসতা বন্ধে ইসির পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এমনকি অনেক স্থানে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে থাকা কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও এসব অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ২১ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের প্রথম পর্বের ভোটে ১৪৮টিতে নৌকা ও ৪৯টিতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীরা জয়ী হন। দ্বিতীয় পর্বে ২০ সেপ্টেম্বর নৌকা জিতে ১১৯ জন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন ৩৬ জন। প্রথম ধাপে সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের ২৬৭ জন (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৭১ জনসহ) এবং স্বতন্ত্র ৮৫ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপে নৌকা জয় পায় ৪৮৬টিতে (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৭৭ জনসহ) এবং ৩৩০টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন। ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় পান ৫২৫টিতে (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৯৯ জনসহ), স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হন ৪৪৬টিতে। ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপে আওয়ামী লীগের ৩৯৬ প্রার্থী (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪৮ জনসহ) চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন; স্বতন্ত্র প্রার্থী জেতেন ৩৯০ ইউনিয়নে। পঞ্চম ধাপে আওয়ামী লীগ জিতেছে ৩৪১টিতে (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৫২ জনসহ) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৪৬টিতে। ষষ্ঠ ধাপে আওয়ামী লীগ জিতেছে ১১৭টিতে (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১২ জনসহ) স্বতন্ত্র ৯৫টিতে। সপ্তম ধাপে আওয়ামী লীগের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন ১১ জন।
প্রাণহানিতে ব্যর্থতা নেই- ইসি :গতকাল ভোট শেষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে ইসি কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, প্রাণহানি দুঃখজনক। নির্বাচনে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে স্থানীয় গোষ্ঠীর মধ্যে মারামারিতে এ দু’জন নিহত হয়েছেন। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে স্থানীয় প্রশাসন।
তিনি বলেন, সর্বোপরি নির্বাচন ভালো হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রমুখী হয়েছেন। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে। নির্বাচন কমিশন প্রাণহানি আশা করে না। এ ক্ষেত্রে কমিশনের ব্যর্থতা নেই। কারণ, সহিংস ঘটনাগুলো স্থানীয়ভাবে সংঘটিত হয়। সরাসরি কমিশনের কোনো দায় নেই। এটা স্থানীয় প্রশাসন দেখবে।
অতিরিক্ত সচিব জানান, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে অনিয়মে জড়িতদের স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে কমিশন। অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তদন্তে অনিয়ম প্রমাণ হলে স্থায়ী বরখাস্ত করা হবে।
ইসির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত সচিব জানান, গতকাল সোমবার ১৩৬টি ইউপিতে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে সাতটিতে নির্বাচন হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। এতে ব্যালট পেপারে ভোট পড়েছে ৬৫ শতাংশের মতো। আর ইভিএমে ভোট পড়েছে ৬১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের অনিয়মে জড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেসব কর্মকর্তা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কমিশন এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে আছে। অনেকের চাকরি চলে যাবে।
এবারের আগে দেশে ৯ বার ইউপি ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে প্রথম। এরপর ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০৩, ২০১১ ও ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচন হয়েছে। ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।